২৯শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার, রাত ৯:৫৮
নোটিশ :
Wellcome to our website...

সংকটে মার্কেটিং-৮/৫ (চাহিদা ব্যবস্থাপনা)

রিপোর্টার
শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৫৮ অপরাহ্ন

অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান।।

(৭) পূর্ণ চাহিদা (Full Demand) : ফ্যাক্টরির পূর্ণ ক্ষমতা ব্যবহার করে যা উৎপাদন করা সম্ভব তার পুরোটাই বাজারে বিক্রি হয়ে যায় এমন একটা আদর্শ অবস্থাকে পূর্ণ চাহিদা অবস্থা বলে। একটি কোম্পানির জন্য সবচেয়ে আদর্শ অবস্থা এটি। কোম্পানির সর্বোচ্চ উৎপাদন ক্ষমতা দিয়ে যা উৎপাদন করা সম্ভব তার পুরোটাই বাজারে বিক্রি হয়ে যায় এর অর্থ হচ্ছে ক্রেতারা কোম্পানির পণ্যটি কিনে সন্তুষ্ট এবং কোম্পানির পণ্য কেনা অব্যাহত রাখছে । এই অবস্থায় ক্রেতারা কোম্পানির নিয়মিত ক্রেতায় পরিণত হয়েছে । এই অবস্থাটা ধরে রাখাই হচ্ছে মার্কেটিং এর প্রধান কাজ। এক্ষেত্রে পণ্যটির চাহিদা বছরের সব সময় একই রকম থাকে। অস্থিতিস্থাপক চাহিদার পণ্যের ক্ষেত্রে পূর্ণ চাহিদার অবস্থাটি বেশি পরিলক্ষিত হয়। কোম্পানি মূল্য কমালে বা বাড়ালেও বিক্রয় বাড়বে কমবে না। ধরা যাক,  ছোট একটি কনফেকশনারী তার পূর্ণ উৎপাদন ক্ষমতা ব্যবহার করে দৈনিক ২০০০ পাউরুটি উৎপাদন করতে পারে এবং তেমন কোনো চেষ্টা ছাড়াই ওইদিনই নির্ধারিত দামে তার সব কটা পাউরুটি বিক্রি হয়ে যায়। নির্দিষ্ট মানের এই পাউরুটি এর চেয়ে কম দামে কারো পক্ষেই বিক্রয় করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রেও মার্কেটিং এর কাজ শেষ হবে না। একজন ক্রেতাও যাতে পাউরুটি কিনতে ভুলে না যায় সেটা তাকে বারবার মনে করিয়ে দিতে হবে। একজন নিয়মিত পাউরুটি ক্রেতাও যদি ভুলক্রমে পাউরুটি না কিনে তাহলে একটি পাউরুটি অবিক্রিত থেকে যাবে। অতএব এক্ষেত্রে মার্কেটিং এর চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কোম্পানির পণ্যের প্রতি ক্রেতাদের আগ্রহ ধরে রাখা। আগে যে পরিমাণ পণ্য বিক্রি  হতো তার চেয়ে বিক্রি কমে গেলে কি করতে হবে তা আমরা পড়ন্ত চাহিদা শিরোনামে আগেই আলোচনা করেছি। পূর্ণ চাহিদার সময়ে কোম্পানির একটাই কাজ সেটা হচ্ছে বর্তমান ক্রেতাদের ধরে রাখা। কিন্তু যারা পূর্ণ চাহিদা আসতে পারেনি অর্থাৎ উৎপাদন ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করে যে পরিমাণ উৎপাদন সম্ভব তা  বাজারে বিক্রি হচ্ছে না । তাদের পণ্য বিক্রি বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করতে হয়। পণ্যের নতুন ব্যবহারকারী খোঁজা, পণ্যের নতুন ব্যবহার উদ্ভাবন এবং যারা বর্তমানে পণ্যটি ব্যবহার করছে তাঁরা যেন আরো বেশি করে ব্যবহার করে তার জন্য  ক্রেতাকে প্রণোদনা দেয়া ইত্যাদি ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।

উৎপাদন ক্ষমতার শতভাগ ব্যবহার ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পে প্রায় বিরল ঘটনা। কারণ বেশিরভাগ কোম্পানি জন্মের সময়ই অতিরিক্ত উৎপাদন ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। বাজারের আয়তন (সম্ভাব্য ক্রেতার সংখ্যা) প্রাক্কলন সঠিকভাবে করা জটিল কাজ।  তাছাড়া পরিবেশের পরিবর্তনের কারণেও প্রাক্কলন যথার্থতা হারাতে পারে। প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা ও অর্থনৈতিক কারণে  অতিরিক্ত উৎপাদন ক্ষমতা নিয়েই বেশিরভাগ কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়। ধরা যাক, কোন মহিলার পরিবারের সদস্য সংখ্যা দুইজন মাত্র। তাদের একটি ভাতের ডেকচি দরকার পৌনে দুই পট চাউলের ভাত রান্নার জন্য। ভদ্রমহিলা দোকানে গিয়ে বলল,  “ভাইয়া আমাকে পৌনে দুই পট চাউলের ভাত রান্না করা যায় এমন একটি ভাতের ডেকসি দিন।” দোকানদার বলবে, “আপু পৌনে দুই পট চাউলের মাপে কোন ডেকসি তৈরি হয় না। অর্ডার দিয়ে যান, বানিয়ে দেয়া যাবে। দাম একটু বেশি পড়বে, আর সাত দিন সময় দিতে হবে।” একথা শুনে মহিলা বলল, ” না ভাই,  কি করে হয়, এই কয়দিন কি না খেয়ে থাকবো”। দোকানদার প্রস্তাব দিবে, “আপু দুই পট চাউলের ভাত রান্না করা যায় এমন একটা ডেকসি নিয়ে যান, একটা বাবু আসার আগ পর্যন্ত একটু জায়গা খালি থাকবে”। এটাই অব্যবহৃত উৎপাদন ক্ষমতা (আন্ডার ইউটিলাইজড প্রোডাকশন ক্যাপাসিটি)। উৎপাদন কাজে ব্যবহৃত বড় বড় বয়লার, ফার্নেস, লেদ মেশিন, ড্রিল মেশিন, কম্প্রেসার এগুলো সিমেন্স, জেনারেল ইলেকট্রিক,ক্যাটারপিলার, মিৎসুবিশি, হ্যুন্দাই কোম্পানি আগেই নির্দিষ্ট সাইজের বানিয়ে রাখে।  যেমন ১০০০ লিটার, ৫০০০ কেজি, ২০টন, ইত্যাদি । কোম্পানির প্রাক্কলনকৃত বাজারের সাইজ অনুযায়ী অর্ডার দিয়ে ৭৮২লিটারের সমপরিমাণের একটি বয়লার বানানো যাবে, তবে এতে অনেক বেশি সময় এবং খরচ লাগবে ।

  তাছাড়া প্রকৃত বাজার প্রাক্কলনের ভিত্তিতে কারখানা প্রতিষ্ঠা করার পরেও বাজারের চাহিদার হেরফেরের কারণে উৎপাদন ক্ষমতা অব্যবহৃত থাকতে পারে। অব্যবহৃত উৎপাদন ক্ষমতার ব্যবহারের জন্য উৎপাদন ক্ষমতা কেন্দ্রিক ডাইভারসিফিকেশন (concentric diversification) এর চেষ্টা করতে হয় অর্থাৎ একই যন্ত্রপাতি,  কাঁচামাল,  শ্রমিক ব্যবহার করে সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু তৈরীর চেষ্টা। আমাদের দেশের সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিগুলো এখন এই সমস্যায় আছে। বেশিরভাগ কোম্পানির উৎপাদন ক্ষমতার ব্যবহার ৫০ শতাংশের নিচে। এসকল কোম্পানির পণ্য হচ্ছে tableware অর্থাৎ বাসনকোসন । জামাকাপড় মানুষ বারবার বদল করে, দিনের মধ্যে একাধিকবারও তা করে। তাই জামাকাপড় কিনেও বেশি। বাসনকোসন দিনে দুই তিন বার ব্যবহার করলেও এক্ষেত্রে বাসনকোসন বদল করার রেওয়াজ নেই। ভাঙার আগে বাসনকোসন বদলে ফেলতে খুব কম পরিবারই দেখা যায় । রাসায়নিক কারণে বাসনকোসন আজকাল সহজে ভাঙ্গেও না। সামর্থ্য থাকলে কলেজ পড়ুয়া মেয়েকে বছরে কয়েকবার জামা কাপড় কিনে দিতে তাঁর মা-বাবা আপত্তি করবে না। একেই মেয়ে যদি মা কে বলে, ” মা আমার খাবার প্লেটটা বদল করে দাও”। মা বলবে, “আগেরটা ভাঙ্গুক, তারপর দেখা যাবে”। ডিনার সেট নামক যে বস্তুটি প্যাকেট করে করে আমরা বিয়ে বাড়িতে উপহার হিসেবে জমা দিয়ে আসি সেই ডিনার সেটে কে কতবার খাবার খেয়েছে হিসাব করলে দেখা যাবে খুবই অপ্রয়োজনীয় এই ডিনার সেট।

আমাদের প্রত্যেকের বাসায় একাধিক ডিনার সেট আছে কিন্তু তেমন কোনো ব্যবহার নেই। ডিনার সেট দিয়ে শোকেস সাজানো একেবারে সেকেলে  ফ্যাশন । এটা এখন আর ঢাকা শহরে চলে না। ঘর সাজানোর জন্য আরও নান্দনিক উপকরণ এখন বাজারে পাওয়া যায়। আমি আমার এক খালার বাসায় গিয়ে বায়না ধরেছিলাম, ডিনার সেট না বের করলে আমি খাব না। এও বলেছিলাম তোমার বাসায় আমার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোন মেহমান আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। খালার বাসায় অনেক দামী দামী কয়েকটি ডিনার সেট ছিল।  যেগুলোতে জীবনেও কেউ কোনদিন খায়নি। খালা আমার পীড়াপীড়িতে বাধ্য হয়ে একটি ডিনার সেটের কয়েকটি আইটেম সেদিন বের করেছিলেন এবং অনেকটা বাধ্য হয়েই তাতে আমাকে খেতে দিয়েছিলেন । তবে পুরো খাওয়ার সময়টায় খালা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন, আমার দিকে নয়, প্লেটের দিকে । কখন খাবার শেষ করব এবং খালা প্লেটগুলো ধুয়ে মুছে যত্নসহকারে আবার আলমারিতে ঢুকাবেন ।

আমার এক বন্ধুর এলিফ্যান্ট রোডে সিরামিক পণ্যের একটি দোকান-শোরুম আছে। কিছুদিন আগে (করোনার পূর্বে) একদিন তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ব্যবসা কেমন চলছে। বললো, “খুবই খারাপ”। আমি বললাম, কেন? সে বলল, “আমাদের সবচেয়ে বেশি বিক্রি হতো শুক্রবার ও শনিবার ,  কারণ ঢাকা শহরে সবচেয়ে বেশি বিয়ে হয় এই দুই দিনে ।  আগে বিয়ের উপহারের জন্যেই সিরামিকসের পণ্যগুলো সবচেয়ে বেশি বিক্রি হতো। এখন বিক্রি একেবারেই কমে গেছে”। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন? কি হয়েছে? এখন কি মানুষ বিয়ে করছে না, নাকি বিয়ের অনুষ্ঠানে মানুষ অন্য কিছু উপহার দিচ্ছে? সে বলল,  “বিয়ে হচ্ছে, সিরামিকসের পণ্যই উপহার দিচ্ছে। তবে নতুন করে কেউ কিনছে না। প্রত্যেক বাসায় উপহার পাওয়া টেবিল ওয়্যারের অনেক প্যাকেট আগের থেকেই মজুত আছে। এগুলোই মাত্র ৩০ টাকা খরচ করে রঙিন পেপার দিয়ে পুনঃপ্যাকিং করে বিভিন্ন বিয়ে বাড়িতে উপহার হিসেবে দিচ্ছে”। আমার এক আত্মীয়কে জানি  তাঁর ছেলের বিয়েতে ৩০ টা ডিনার সেট উপহার পেয়েছিল। এগুলোর স্থান সংকুলান করতে না পেরে সেও একই পদ্ধতিতে বিভিন্ন বিয়ে বাড়িতে সেগুলো উপহার দিয়ে এসেছে।

 সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিগুলো  তাদের অব্যবহৃত উৎপাদনক্ষমতা ব্যবহার করার জন্য উৎপাদন ব্যবস্থা কেন্দ্রিক ডাইভারসিফিকেশন কৌশল হিসাবে একই উৎপাদন প্রক্রিয়া, একই কাঁচামাল এবং একই শ্রমিক দিয়ে সম্পূর্ণ নতুন বাজারের জন্য নতুন কিছু তৈরি করতে পারে। সেক্ষেত্রে যদি সিরামিক কোম্পানিগুলো বিদ্যুৎ অপরিবাহী ইলেকট্রিক ইনসুলেটর তৈরি করে তাহলে নতুন যন্ত্রপাতি প্রয়োজন হবে না । এক্ষেত্রে নতুন কাঁচামালও লাগবে না এবং শ্রমিক লাগবে না। যা আছে তা দিয়েই বৈদ্যুতিক ইনসুলেটর তৈরি করা যাবে।  কেবলমাত্র ডাইস পরিবর্তন করে দিলেই বাসনকোসন এর জায়গায় ইলেকট্রিক ইনসুলেটর তৈরি হবে। তবে ইলেকট্রিক ইনসুলেটর বিক্রি করার জন্য এলিফ্যান্ট রোড শোরুম খুললে চলবে না। এর জন্য মতিঝিলে বা গুলশানে  একটি অফিস খুলতে হবে এবং সরকারি টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে হবে। কারণ ইলেকট্রিক ইনসুলেটরের  ক্রেতা সাধারণ পারিবারিক ভোক্তা একেবারেই কম। ইলেকট্রিক ইনসুলেটর ক্রেতারা প্রাতিষ্ঠানিক ক্রেতা যেমন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড,  ডেসা, আরইবি ইত্যাদি সরকারি সংস্থা। সরকারি সংস্থার নিকট পণ্য বিক্রি করতে গেলে সরকারি নিয়ম অনুযায়ী টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে হবে।  আর সরকারি ক্রয়ের ক্ষেত্রে যে সর্বনিম্ন দাম দিবে অথবা সবচেয়ে বেশি ঘুষ দিবে সরকারি সংস্থাগুলো তার থেকে পণ্য কিনে । এর বাইরে ইলেকট্রিক ইনসুলেটর ক্রেতা হতে পারে বিভিন্ন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করতে গেলও কোথায়ও কোথায়ও অকশন,  টেন্ডার অথবা নেগোসিয়েশন এর মাধ্যমে বিক্রি করতে হয় যা শোরুম বা বিক্রয় কেন্দ্রে বাসনকোসন বিক্রি করার থেকে সম্পূর্ণ পৃথক একটি বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়া । এক্ষেত্রে শুধু উৎপাদন আগের পদ্ধতিতেই হবে  কিন্তু মার্কেটিং ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে।

(৮) মাত্রাতিরিক্ত চাহিদা ( Overfull Demand) : কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান তার পণ্যের জন্য যতটুক চাহিদা কাম্য বলে মনে করে , অথবা যেই পরিমাণ চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ দেয়ার সক্ষমতা রাখে তার চেয়ে যদি চাহিদার পরিমাণ অনেক বেশি হয়ে যায় তখনই  মাত্রাতিরিক্ত চাহিদার অবস্থা সৃষ্টি হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের ভর্তির সময়, পহেলা বৈশাখে ইলিশের বাজারে, অফিস আওয়ারে ঢাকার রাস্তায় মিনিবাসে,  বৃহস্পতিবারে সদরঘাটের লঞ্চ টার্মিনালে বা বাংলা একাডেমির বইমেলায় অনুরূপ অবস্থার সৃষ্টি হয়। এখানে ব্যবস্থাপকের কাজ হচ্ছে ডিমার্কেটিং (demarketing) করা। এই কাজটি করা হয় বর্তমান উপচেপড়া  চাহিদাকে আপাতত সীমিত করার জন্য,  স্থায়ীভাবে ধ্বংস করার জন্য নয়। মূল্য বাড়িয়ে,  প্রচার ও সেবা কমিয়ে এমনটি করা যায়। অন্যান্য কিছু শর্তারোপ করেও চাহিদা কমানো যায় । তবে মনে রাখতে হবে ডিমার্কেটিং এর উদ্দেশ্য চাহিদা চিরতরে ধ্বংস করা নয় আপাতত সীমিত করা। কারণ উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো গেলে এই বাড়তি চাহিদা ব্যবহার করে দীর্ঘমেয়াদে কোম্পানি লাভবান হতে পারবে।

ধরা যাক ছোট্ট একটি পাউরুটির কারখানা দৈনিক ৫০০ পিস পাউরুটি তৈরি করার ক্ষমতা রাখে কিন্তু পাউরুটি নেয়ার জন্য সাতশ’ লোক চলে আসলো।  এই অবস্থাটি স্বস্তিকর অবস্থা ভাবার  কোন কারণ নেই । যারা পাউরুটি পাবে না তারা কিন্তু বিভিন্ন ঝামেলা তৈরি করতে পারে। কলাপসিবল গেটে ধাক্কাধাক্কি,  ঢিল মেরে জানালার কাঁচ ভেঙ্গে ফেলা,  দাঙ্গা-হাঙ্গামা, এমনকি যারা পাউরুটি পাবে তাঁদের থেকে পাউরুটি কেড়ে নেয়ার মতো ঘটনাও ঘটতে পারে।  এক্ষেত্রে কারখানাটি প্রথমেই যা করতে পারে তা হল, পাউরুটির দাম বাড়িয়ে চাহিদা কমিয়ে আনা। দ্বিতীয় কাজটি হচ্ছে ঘোষণা করে দেয়া, “গতকালকের পাউরুটির খালি প্যাকেট জমা দিলেই কেবল আজকে পাউরুটি  পাওয়া যাবে”। তাহলে নতুন করে কেউ পাউরুটি নিতে আসতে পারবে না। এই সময়ের মধ্যে কারখানাটি উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করতে পারে।

 প্রত্যেক বছর বাংলা একাডেমির বইমেলায় এই অবস্থাটি  তৈরি হয় ।  বাংলা একাডেমির একুশের বইমেলায় প্রতিদিন যদি দুই লক্ষ লোকও আসে  তাহলেও সামাল দেয়া যায় । কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারির আগে পরে কয়েকদিন প্রতিদিন মেলায় লোক আসে ৫ লক্ষের মত । প্রায় প্রতিদিনই বাংলা একাডেমিতে বই মেলায় একটা ভিড় লেগেই থাকে। যারা যারা মেলায় আসে এবং প্রতিদিন ভিড় জমায়  তাঁরা যে সবাই বইয়ের ক্রেতা অথবা পাঠক এমন মনে করার কোন কারন নাই। নেহাতই আড্ডা এবং বিনোদনের উদ্দেশ্যে বাংলা একাডেমিতে আসে এবং কিছুসংখ্যক লোক প্রায় প্রতিদিনই আসে। এরকম একটি উপচেপড়া ভিড় সামাল দেয়ার জন্য বাংলা একাডেমি যা করতে পারে: প্রথমেই, প্রবেশ মূল্য স্থির করতে পারে এবং নির্দিষ্ট গেট দিয়ে ঢুকতে ১০টাকার টিকিট করে ঢুকতে হবে । ১০ টাকা প্রবেশ ফি তে যদি ভিড় না কমে তখন প্রবেশ মূল্য ২০টাকা করা যেতে পারে। এর বেশি প্রবেশ মূল্য নির্ধারণ করলে ব্যাপক সমালোচনা হবে।  অবশ্য যে কোন মূল্য ধার্য্ করলেই এটা সমালোচনার বিষয় হবে। অনেকেই বলবে,  “বাংলা একাডেমি কী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হইয়া গেল”!  অতএব প্রবেশ মূল্য বৃদ্ধি খুব জুৎসই সমাধান হবে বলে মনে হয় না।  সে ক্ষেত্রে বলতে হবে যারা এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষায় প্রথম বিভাগ বা জিপিএ- ৫ পেয়েছে তারাই শুধু  সনদপত্র দেখিয়ে ঢুকতে পারবে। তারপরও যদি ভিড় কমানো না যায় তখন বলতে হবে প্রত্যেককে একটি চারিত্রিক সনদপত্র নিয়ে ঢুকতে হবে।(বিষয়টা বুঝার জন্য এই উদাহরণগুলো ব্যবহার করছি,  বাস্তবে হয়তো এগুলোর কোনটাই সম্ভব নয়)। এগুলো হচ্ছে মূল্যের বাইরে গিয়ে কতগুলো  নন-ট্যারিফ  ব্যবস্থাপনা।

 সরকারকে সব সময়ই খারাপ ব্যবসায়ী মনে করা হয়।  কারণ সরকার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লোকসানে বা ভর্তুকি দিয়ে পণ্য বা সেবা বিক্রি করে। যার কারণে সরকারি পণ্য কেনার জন্য সব সময় লম্বা লাইন পড়ে যায়।  অর্থাৎ সরকার অধিকাংশ ক্ষেত্রে যে দামে পণ্য কিনে তার চেয়ে কম দামে পণ্য বিক্রি করে এবং এটা সব সময় বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক  কম হয়।  রাজউকের প্লট বিক্রি এর উদাহরণ।  বাজার মূল্যের দশ ভাগের এক ভাগ মূল্যে প্লট বিক্রি করে।  রাজউক যখন ১০০০ প্লট বিক্রির জন্য বিজ্ঞাপন দেয় তখন কয়েক লক্ষ লোক প্লটের জন্য আবেদন করে।  এত বেশি আবেদন পড়ে যে এগুলো যাচাই-বাছাই করে প্লট বরাদ্দ করা,  এমনকি নিজের দলীয় লোকদেরকে প্লট বরাদ্দ দেয়াও অসাধ্য হয়ে পড়ে । যার কারণে আবেদনের  সংখ্যা সীমিত রাখার জন্য রাজউক এমন কিছু শর্ত যুক্ত করে দেয় যা অধিকাংশ আবেদনকারীর পক্ষে মিটানো বা জোগাড় করা সম্ভব হয় না।যেমন আবেদনকারীকে তাঁর জন্ম সনদ জমা দিতে হবে এবং আবেদনকারী তাঁর পিতা-মাতা হিসাবে যাদের নাম উল্লেখ করেছে সে তাঁদের বৈধ সন্তান কিনা তার প্রমাণ স্বরূপ বাবা-মার বিয়ের কাবিননামা রেজিস্ট্রেশনের কপি জমা দিতে হবে;  ইত্যাদি, ইত্যাদি।

 সামর্থ্য এবং যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও আমি কয়েকবারই রাজউকের প্লটের জন্য দরখাস্ত করতে পারিনি,  কেবলমাত্র এই সকল কাগজপত্র জোগাড়ের বিড়ম্বনার জন্য। সর্বশেষ যখন পূর্বাচলে প্লট বরাদ্দের বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয় তখন আমাদের বিজনেস ফ্যাকাল্টির খুবই স্মার্ট এক পিয়ন আমাকে এসে বললো, “স্যার কোন চিন্তা করবেন না, সব কিছু আমি জোগাড় করে দিব। আপনি শুধু রাজউকে গিয়ে ৮৫ হাজার টাকা জমা দিয়ে মূল আবেদন পত্রের ফর্মটি এনে আমাকে দিয়ে দিবেন। বাকি সব  ডকুমেন্ট আমি জোগাড় করে সুন্দরভাবে আবেদন জমা দিয়ে দিব”। আমি তার কথায় আশ্বস্ত হয়ে একদিন রাজউক অফিস গিয়ে পাঁচ কাঠার একটি প্লট এর জন্য ৮৫ হাজার টাকা জমা দিয়ে আবেদনপত্রটি উত্তোলন করে আমার সেই পিয়নের হাতে দিয়ে  দেই। প্রায়ই খোঁজ রাখতাম সে আবেদনপত্র জমা দিয়েছে কিনা। জুন মাসের শেষ সপ্তাহে এসে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “আবেদনের কি অবস্থা? সে বলল, “স্যার মোটামুটি সব কিছু জোগাড় হয়ে গেছে,  আর একটা ডকুমেন্ট হলেই আবেদন জমা দিতে পারবো” ।  আমি বললাম কি সেটা? “স্যার আপনার একটা চারিত্রিক সনদপত্র লাগবে”। আমি বললাম,  আমি তো প্রতিদিন বহু লোককে চারিত্রিক সনদপত্র দেই, আমারটা কে দিবে ?  “স্যার চিন্তা করবেন না, আমি ব্যবস্থা করব”। আমি বললাম,  “ঠিক আছে জোগাড় করো, কিন্তু কি কি জমা দিলে তার এক সেট ফটোকপি রাখবে”। সত্যি সত্যি ৩০ জুনের আগেই আমার সেই পিয়ন সকল ডকুমেন্টসহ রাজউকে আবেদন জমা দিল এবং পুরো আবেদন পত্রের এবং সকল কাগজপত্রের এক সেট ফটোকপি আমাকে দিয়ে গেল।  ব্যস্ত থাকায় আমি এটা দেখতে পারিনি। কিছুদিন পরে হঠাৎ করে  মনে পড়লে ভাবলাম, দেখিতো সে কি কি ডকুমেন্ট জমা দিল।  এটা দেখতে গিয়ে দেখি শাহবাগের ওয়ার্ড কমিশনার খাজা হাবিবুল্লাহ এর অফিসিয়াল প্যাডে একটি প্রশংসাপত্র। তাতে লেখা আছে- “ডঃ মীজানুর রহমান, পিতা-আব্দুল গনি … তাহাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি, তাঁহার চরিত্র ভালো । তাঁহার সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল কামনা করি”।

ঘটনাটি এখানেই শেষ হলেই ভালো ছিল। এর মাত্র মাসখানেক পরের ঘটনা। তখন ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ নামে একটা পুলিশি অভিযান চলছিল।এখন যেভাবে বন্দুকযুদ্ধে মানুষ মারা যায় তখনও পুলিশ কর্তৃক ধৃত ব্যক্তিরা ঐদিন ভোররাত্রে হার্ট অ্যাটাকে মারা যেত। টেলিভিশন নিউজে দেখলাম পুলিশের ভাষ্যমতে খাজা হাবিবুল্লাহ সাতটি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ও প্রচুর বিদেশী মদসহ ধরা পরেছে। হার্ট অ্যাটাক না হওয়ায় পরবর্তীতে জামিনে থাকা খাজা হাবিবুল্লাহ আরেকটি অভিযানেও ধরা পড়ে। সেখানে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল ‘ইয়াবা’ সংক্রান্ত। আমি নিজে শুনেছি,  টিভিতে সাক্ষাৎকার দিয়ে খাজা বলছে, ” মাঝেমধ্যে আমি ‘ইয়াবা’ খাই, তবে ব্যবসা করি না”।  এখন প্রশ্ন হচ্ছে ওয়ার্ড কমিশনার খাজা হাবিবুল্লাহকে রিমান্ডে নিয়ে যদি পুলিশ জিজ্ঞেস করত,  “তুই কাকে কাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনিস? তখন আমার কি উপায় হত। যদিও খাজা হাবিবুল্লার সাথে আমার জীবনেও কোনদিন দেখা হয়নি। এই গল্পটা বললাম এই জন্য যে স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনার থেকে চারিত্রিক সনদপত্র নিতে হবে, এইজন্যেই অনেক বিশ্ববিদ্যালের অধ্যাপক রাজউকের প্লটের জন্য আবেদন করেন না। ওয়ার্ড কমিশনারের দেয়া চারিত্রিক সনদপত্রের বাধ্যবাধকতার কথা আগে জানলে আমিও হয়তো এই প্লটের জন্য দরখাস্তের বিষয়ে দ্বিতীয়বার ভাবতাম। রাজউকের বিধিমালা অনুযায়ী একমাত্র ওয়ার্ড কমিশনারের চারিত্রিক সনদপত্রই গ্রহণযোগ্য হবে। এ ধরনের কিছু অগ্রহণযোগ্য, অন-অর্জনযোগ্য ও অনভিপ্রেত শর্তের কারণে আবেদনের সংখ্যা সীমিত থাকে;  রাজউক সহজে প্লট বরাদ্দ করতে পারে। এমনকি ‘নিজের লোকদের’ বাছাই করতেও তাঁদের সুবিধা হয়।…(চলবে)

(ড. মীজানুর রহমান, উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং আহ্বায়ক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম)


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ
এক ক্লিকে বিভাগের খবর