২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার, সকাল ১১:৪৯
নোটিশ :
Wellcome to our website...

সংকটে মার্কেটিং-৭

রিপোর্টার
শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৪৯ পূর্বাহ্ন

অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান,

বাজার অর্থনীতির মূল প্রবক্তা অ্যাডাম স্মিথ(১৭২৩-১৭৯০) ” homo economicus” বা “economic man” তত্ত্বের জনক। ১৭৫৯ সালে প্রকাশিত তাঁর “The theory of moral sentiments” বইয়ে অর্থনৈতিক মানুষের ধারণার সূচনা করেন। মানুষ কেবলি “অর্থনৈতিক মানুষ”, এটা মানুষ সম্পর্কে খন্ডিত ধারণা বলে এর প্রচুর সমালোচনা আছে। তারপরও এ ধারণার সমর্থকের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। উনিশ শতকের দার্শনিক Rene’ Descarts, Gottfried Wilhelm, Jeremy Bentham থেকে John Stuart Mill পর্যন্ত অনেকেই “অর্থনৈতিক মানুষ” ধারণার সমর্থক ছিলেন । Economic man তত্ত্বে মানুষের যে বৈশিষ্ট্যগুলোকে তুলে ধরা হয় তা হল- মানুষ আগাগোড়া যোক্তিক, মোটামুটি স্ব-স্বার্থে তাড়িত এবং সে ব্যক্তিগত ব্যাখ্যাকে কাম্য(optimum) ব্যাখ্যা হিসাবে দাঁড় করাতে চায়। পরিপূর্ণ জ্ঞান নিয়ে সে সবসময় উপযোগ বা সন্তুষ্টিকে সর্বোচ্চ করতে চায়। ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ আলফ্রেড মার্শাল (১৮৪২-১৯২৪) যিনি প্রান্তিক উপযোগ ও ভোক্তার উদ্বৃত্ত তত্ত্বের জনক তিনিও ‘অর্থনৈতিক মানুষ’ তত্ত্বকে সমর্থন করেন। মার্শালের বক্তব্য ছিল cost-benefit বিশ্লেষণ না করে মানুষ কিছু করে না । ব্যবসায়ীরা যেমন ‘রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট’ বা ROI হিসাব করেই ব্যবসায় নামে তেমনি পণ্যের মূল্য এবং প্রাপ্তব্য সুবিধার একটা তুল্য বিচার না করে মানুষ কোন কিছু কিনে না। (‘রিটার্ন অনইনভেস্টমেন্ট’এর বাংলা বলেছিলাম “কত ধানে কত চাল “। এরচেয়ে ভালো বাংলা কেউ বলতে পারলে সেটা গ্রহণ গ্রহণ করে নিব। ‘স্টেকহোল্ডার’ এর আমার সুপারিশকৃত বাংলা হচ্ছে- ‘যাদের যায় আসে’। এটারও একটা ভালো বাংলা শব্দের জন্য পাঠকদের প্রস্তাব আহবান করছি।) মন্দার সময় কি পণ্য কত দামে বিক্রি হবে এই প্রশ্নের জবাব আলফ্রেড মার্শালের ইকুইলিব্রিয়াম তত্ত্বে(equilibrium theory) পাওয়া যায় । মূল্য ও উৎপাদন চাহিদা ও যোগানের ভারসাম্য দ্বারা নির্ধারিত হয়। এক্ষেত্রে চাহিদা ও যোগানের স্থিতিস্থাপকতার বিষয়টিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সংকট মোকাবেলায় উপরের দার্শনিক আলোচনাটি প্রাসঙ্গিক বলে মনে করছি। ক্রেতারা বিলাসিতা পরিহার করছে বা করতে বাধ্য হচ্ছে। আবশ্যকীয়তা তাদেরকে প্রধান বিবেচ্য হিসাবে স্থান পাচ্ছে। মূল্য সাশ্রয়ী ব্র্যান্ড এবং জেনেরিক পন্যের দিকে ঝুঁকছে ক্রেতারা। বিদেশি দামি পণ্য বাদ দিয়ে দেশী বিকল্প পণ্য খুঁজছে।অপেক্ষাকৃত ছোট প্যাকেট বা লট এখন তাদের পছন্দ। পণ্যের জীবন চক্র খরচ, স্থায়িত্ব এবং অর্থের বিপরীতে প্রাপ্ত ‘ভ্যালু’ ক্রেতারা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বিবেচনা করছে। বিনামূল্যে পাওয়া উপহারের প্রতি এ সময়ে কোনো আকর্ষণ থাকে না। কল্পনা ভিত্তিক আবেগীয় বিজ্ঞাপনের চেয়ে তথ্যভিত্তিক যৌক্তিক আবেদনময়ী বিজ্ঞাপনের প্রতি তাদের আগ্রহ বেশি থাকে। করোনার তীব্রতা কমে গেলেও মানুষের কাজ বাড়বে না। বেশি সময় হাতে থাকবে অথচ আর্থিক টানাটানির কারণে বিনোদনের ব্যয়বহুল পদ্ধতিগুলোর দিকে তাঁরা যেতে পারবে না। তখন বিনোদনের একটা মাধ্যম হবে “উইন্ডো শপিং” । বাজারে ঘুরে ঘুরে জিনিসপত্র দেখা, কেন নয়। কেনার সময় ডিসকাউন্ট দেয়া দোকান বা বাড়ির পাশের দোকান থেকেই জিনিস কিনবে। লোভনীয় পণ্যের( ইম্পালস প্রোডাক্ট) বিক্রয়, দোকান বা বাজার থেকে বের হওয়ার সময় শেষ মুহূর্তে চোখে পড়া পণ্যের ক্রয় কমে যাবে। মন্দার সময় ক্রেতার পরিবর্তনগুলোকে আমলে নিয়ে বাজারজাতকরণ মিশ্রণ সাজাতে হবে। দুর্বল বাজার অংশ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। যে বাজারে কোম্পানির ব্র্যান্ডের শক্তিশালী অবস্থান আছে সেখানেই অবস্থান আরো শক্তিশালী করতে হবে। সুযোগ থাকলে দুর্বল প্রতিযোগীর ব্যবসায় ক্রয়ের এটা খুব ভালো সময়। স্থায়ী পণ্যের ক্ষেত্রে ক্রেতারা পণ্যের ‘রিসেল ভ্যালুর’ প্রতি বেশি মনোযোগী হবে। এটাকে পণ্য ক্রয়ের যৌক্তিকতা হিসাবে ক্রেতার সামনে তুলে ধরতে পারলে কাজ দেবে।
দুর্বল পণ্য বাতিল করারও এটা সবচেয়ে ভালো সময়, তবে এ সময়ে শূন্যস্থান পূরণ করার জন্য নতুন পণ্য বাজারে ছাড়া বোকামি হবে। প্রয়োজনে ‘ফাইটিং ব্র্যান্ড’ বাজারে ছাড়তে হবে যা ক্রেতার ও প্রতিযোগিতার পরিবর্তনের সাথে বাজারে অবস্থান করে নিতে পারবে। কেউ কেউ দ্বিতীয় সারির ব্র্যান্ডকে সামনে আনার পরামর্শ দেন। অনেকটা স্ট্রাইকারদের গোল করার ব্যর্থতা দেখে ফুটবলের কোচ যেমন ব্যাক লাইনের খেলোয়ারদের বা ডিফেন্ডারদের সামনে পাঠায় গোল করার জন্য। কলম্বিয়ার ফুটবল টিমের গোলকিপার Rene’ Higuita (El Loco) কে প্রতিপক্ষের গোলপোস্ট পর্যন্ত গিয়ে গোল করতে দেখা গেছে। এই গোলকিপারের আন্তর্জাতিক মানের ফুটবল খেলায় গোলের সংখ্যা ৪১টি।
ব্র্যান্ডগুলোকে পরিবর্তিত অবস্থার প্রেক্ষিতে তাদের অবস্থান ব্যাপক অভিযোজন করে নিতে হবে। সহজ সরল এবং অপেক্ষাকৃত টেকসই পণ্যের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। পণ্যের অতিরিক্ত অংশ (augmented product) হিসেবে ওয়ারেন্টি(warranty) এ সময়ে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় হতে পারে। ক্রেতার নিকট দাম স্থির রেখে মান বাড়ানো গেলে সবচেয়ে ভালো । মূল্য কমালেও মান বজায় রাখতে হবে । মান এবং দাম একসাথে কমানোর কৌশল এই মুহূর্তে পরিহার করাই ভালো। পণ্যের জীবন চক্র মূল্য কৌশল কার্যকর করতে হবে।
বিজ্ঞাপনের বাজেট কমানো যাবেনা। বড় ব্র্যান্ডগুলোর সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে মার্কেটিং বাজেট কমে যাওয়া। কোথাও হয়তো অর্ধেকে নেমে এসেছে। স্বাভাবিকভাবেই এই অল্প টাকা স্বল্পমেয়াদী কার্যসম্পাদন মার্কেটিং (performance marketing) এবং বিক্রয় প্রসারের কাজেই ব্যয় করা শ্রেয় বলেই অনেকেই মনে করতে পারেন। এটা হবে মারাত্মক ভুল। দ্রুত বিক্রির জন্য আবেদনময়ী ক্রেতা প্রণোদনা অথবা বিক্রয় বৃদ্ধির চাতুর্যপূর্ণ কর্মকাণ্ড কোনটা দিয়েই বর্তমানে ভয়ার্ত, ঘরে বন্দি , ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত ভোক্তাদের ক্রয়ে প্ররোচিত করা যাবে না। মার্কেটিং বাজেট অর্ধেকে নেমে আসলেও দীর্ঘমেয়াদী ব্র্যান্ড বিল্ডিং কাজেই এটা ব্যয় করা উচিত। এটা না করে কার্যসম্পাদন মার্কেটিং চেষ্টা বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যর্থ হতে বাধ্য। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও টেলিভিশন বিজ্ঞাপন বাড়াতে হবে। যৌক্তিক আবেদন এবং প্রচ্ছন্ন নিশ্চয়তা বেশি কার্যকর হয়। বিশেষজ্ঞদের স্বীকৃতি, সনাতনভাবে সম্মানিত ব্যক্তিত্ব এবং সন্তুষ্ট ক্রেতার প্রশংসার প্রতি অডিয়েন্সের আগ্রহ থাকে। এ সময় সেলিব্রিটিদের স্বীকৃতি তেমন আবেদন সৃষ্টি করে না। ক্রেতাদের জন্য ক্রয় করার পরামর্শ দেয়ার মত সুর বিজ্ঞাপনে না থাকাই ভালো। জনসংযোগ কার্যক্রম এসময়ে জোরদার করতে হবে। করোনা সংকটের সময় কোম্পানির সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে মানুষের জন্য কার্যক্রমগুলোর ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা নিতে হবে। কাজটা যথাযথ নৈপুণ্যের সাথে করতে না পারলে ‘লোক দেখানো’ কর্মকান্ড হিসাবে এটা কোম্পানির ইমেজ ক্ষুন্ন করতে পারে। বিক্রয় প্রসার হাতিয়ার হিসেবে ডিসকাউন্ট বা প্রিমিয়াম কিছুটা কাজে আসলেও লটারি, ‘লাকী কুপন’ কোন কাজে আসবে না। তবে ক্রেতা আনুগত্যের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা যেতে পারে। বিক্রয় কর্মীদের ক্রেতাদের জিজ্ঞাসার জবাবের ব্যাপারে পূর্ব প্রশিক্ষণ দিতে হবে এবং আপত্তি মোকাবেলার কৌশলও তাদের শিখাতে হবে।
মন্দার সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাজারজাতকরণ মিশ্রণ হাতিয়ার হচ্ছে বন্টন। বণ্টন এসময়ে আরও বেশি গুরুত্ব পাবে। বন্টন প্রণালীতে যারা কম দামে পণ্য বিক্রি করে যেমন- ভোক্তা ক্লাব, ডিসকাউন্ট হাউস এবং পাইকারি বিক্রয় কেন্দ্রের প্রতি অধিক গুরুত্ব দিতে হবে কারন তারাই সবচেয়ে কম দামে ভোক্তাদের নিকট পণ্য বিক্রয় করতে পারে। অলাভজনক দোকানে বিক্রয় বন্ধের এটাই সময়। অনেক সময় মাঠ পর্যায়ের বিক্রয়কর্মীরা দোকানদারের সাথে ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব ও চক্ষু লজ্জার খাতিরে এসকল অলাভজনক বিক্রেতার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখে। অলাভজনক সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। অনলাইন সহ বিভিন্ন বিকল্প চ্যানেলগুলোর কথা বিবেচনা করা যেতে পারে।

( লেখক : ড. মীজানুর রহমান, আহ্বায়ক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম এবং উপাচার্য,
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।)


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ
এক ক্লিকে বিভাগের খবর