৩০শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার, সকাল ৭:৪৬
নোটিশ :
Wellcome to our website...

সংকটে মার্কেটিং ১১/২ প্রবৃদ্ধি কৌশল (growth strategies)

রিপোর্টার
শনিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৪৬ পূর্বাহ্ন

অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান।।

(সংকটে মার্কেটিং-১১/১ এর পর থেকে) ব্যবসায় প্রবৃদ্ধির  জন্য দ্বিতীয় পদ্ধতিটি হচ্ছে সমন্বিত প্রবৃদ্ধি (integrative growth)। শিল্পের মধ্যেই পশ্চাৎ, সম্মুখ, ও ভূসমান্তরাল সমন্বয়ের মাধ্যমে কোম্পানীর বিক্রয় ও মুনাফা বৃদ্ধি সম্ভব। একটি মিষ্টির দোকানের কথা ধরা যাক, মিষ্টির দোকানে মিষ্টি বিক্রি করে যে টাকা আয় হয় তার সিংহভাগই দিয়ে দিতে হয় দুধওয়ালাকে (গোয়ালা)। তাছাড়া বিভিন্ন কারণে বিশেষ করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার কারণে সরবরাহ ব্যবস্থার মধ্যে বিঘ্ন সৃষ্টি হতে পারে।  একটি মিষ্টির দোকানের খুব বেশি হয়তো অসুবিধা হতো না, যদি দুধওয়ালা শুধু তাকেই দুধ সরবরাহ করতো। অথবা দেশে মাত্র একজনই দুধওয়ালা আছে যে সকল মিষ্টির দোকানের দুধ সরবরাহ করে। এখানে বিপদজনক বিষয়টি হচ্ছে, যে দুধওয়ালা মানিকগঞ্জ থেকে দুধ নিয়ে আসে সে কেবলমাত্র ‘যাদব ঘোষ’কেই দুধ দেয় তা নয়। তার পার্শ্ববর্তী প্রতিদ্বন্দ্বী মোহন চাঁদ, মরন চাঁদ, কালা চাঁদ এ চারজনকেই দুধ সরবরাহ করে। কোন কারনে একদিন মানিকগঞ্জ থেকে দুধ নিয়ে আসার সময় এক সন্ত্রাসী ঘটনায় পড়ল এবং সন্ত্রাসীরা তার প্রায় সব দুধ খেয়ে ফেলল। দুধওয়ালা সামান্য একটু দুধ আর নিজের জীবনটা নিয়ে কোনরকমে ঢাকায় আসলো। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই সামান্য একটু দুধ সে কাকে দিবে? বড়জোর একজনকে দেয়া যায়। সে ক্ষেত্রে এই চারজনের মধ্যে যার সাথে সম্পর্ক সবচেয়ে ভালো তাকেই দুধ দিয়ে চলে যাবে। অন্যদের সাথে দেখাও করবে না। ধরা যাক, যাদব ঘোষ এর সাথে তার সম্পর্ক সবচেয়ে ভালো, সে যাদব ঘোষকেই দুধ দিয়ে চলে যাবে। বাকিরা দুধ পাবে না, মিষ্টিও বানাতে পারবে না। হঠাৎ করে এক দিনের জন্য ভিন্ন সোর্স থেকে দুধ পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা থাকে না। মোহন চাঁদের মিষ্টির  দীর্ঘ দিনের এক পুরনো কাস্টমার(বান্ধা কাস্টমার), যে প্রায় গত বিশ বছর যাবত মোহন চাঁদ থেকে মিষ্টি নেয়, তাঁর নাতির আজ জন্মদিন। সে মিষ্টি কিনতে এসে দেখল দুধের অভাবে মোহন চাঁদ আজ মিষ্টি  বানাতে পারেনি। এক্ষেত্রে নিশ্চয় সে নাতির জন্মদিন পিছিয়ে দিবে না। স্বভাবতই সে পার্শ্ববর্তী যাদব ঘোষের দোকানে মিষ্টির জন্য যাবে। আর যাদব ঘোষ দীর্ঘদিন যাবৎ এই কাস্টমারের জন্যই অপেক্ষা করছিল। যাওয়ার সাথে সাথেই সে ওই কাস্টমারকে দুইটা মিষ্টি বিনামূল্যে স্যাম্পল হিসাবে খেতে দিল। দীর্ঘদিন মোহন চাঁদের মিষ্টি খেতে খেতে হঠাৎ করে যাদব ঘোষের মিষ্টি খাওয়ায় তার কাছে এটা অসম্ভব টেস্টি এবং সফট মনে হল।(বছরে একদিন হঠাৎ করে পহেলা বৈশাখে রমনায় পান্তা ভাত খেলে যতটা মজা লাগে অনেকটা সেই রকম,  যদিও যাদের কপালে প্রতিদিন কেবল পান্তা ভাতই জোটে তাদের ততটা মজা লাগে না।) যাদব ঘোষও নতুন ক্রেতার সম্মানার্থে অন্যান্য দোকানের চেয়ে কেজিপ্রতি ৫ টাকা কমে তাকে মিষ্টি দিয়ে দিল। এরপর থেকে ওই কাস্টমার যাদব ঘোষ থেকেই মিষ্টি কেনা শুরু করল অর্থাৎ মোহন চাঁদের একজন স্থায়ী কাস্টমার হারিয়ে গেল। মোহনচাঁদকে আজকে একজন স্থায়ী কাস্টমারের  নিকট এক কেজি মিষ্টি বিক্রির লাভ হারানোটা হিসাব করলেই হবে না, তাকে হিসাব করতে হবে ওই কাস্টমার বাকি জীবনে যত মিষ্টি কিনতো  তা থেকে কত লাভ আসতো সেটা। এটাকে বলা হয় ক্রেতার লাইফটাইম ভ্যালু(lifetime value)।

এ সমস্যার সবচেয়ে ভালো সমাধান হচ্ছে সম্ভব হলে নিজে একটি ডেইরি ফার্ম দেয়া। দুধ এবং মিষ্টির সম্মিলিত আয় কোম্পানির প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক হবে। এটাকে বলা হয় ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ বা ব্যাকওয়ার্ড ইন্টিগ্রেশন। বিপরীত দিকে বাংলাদেশের অনেকগুলো ডেইরি ফার্ম নিজের উদ্যোগেই ননী, ঘি এবং মিষ্টি তৈরি করে নিজস্ব দোকানে বিক্রি করছে অথবা বিভিন্ন মিষ্টির দোকানে এগুলো সরবরাহ করছে। (ঢাকার বাসাবো এলাকায় “সালাম ডেইরি ফার্ম এন্ড ফুড প্রোডাক্টস” নামে একটি ডেইরি ফার্ম এখন একাধিক মিষ্টির দোকান পরিচালনা করছে)। এটাকে বলে ফরওয়ার্ড ইন্টিগ্রেশন। অর্থাৎ কোম্পানী তার যেখানে অবস্থান সেখান থেকে সামনের দিকে অথবা পিছনের দিকে যেতে পারে। কোম্পানী যাদের নিকট পণ্য বিক্রি করতো তারা যদি সেই ক্রেতাদের  ব্যবসায়টা শুরু করে তখন সেটা হয় ফরওয়ার্ড ইন্টিগ্রেশন । অপরদিকে কোম্পানী যাদের নিকট  থেকে ক্রয় করতো  সেই বিক্রেতাদের কাজটা যদি নিজেই করে তখন এটাকে বলা হয় ব্যাকওয়ার্ড ইন্টিগ্রেশন। ফরওয়ার্ড এবং ব্যাকওয়ার্ড ইন্টিগ্রেশনকে একসাথে ভার্টিক্যাল ইন্টিগ্রেশন বলে। বাংলাদেশে বাটা সু কোম্পানী জুতা তৈরি করে এবং সারাদেশে তারা পাইকারি ও খুচরা বাজারে নিজস্ব উদ্যোগে অথবা তত্ত্বাবধানে ডিস্ট্রিবিউটর এবং এজেন্সির মাধ্যমে ক্রেতার নিকট জুতা বিক্রি করছে, এটাকে বলা হয় ফরওয়ার্ড ইন্টিগ্রেশন। বাটা কোম্পানী ইচ্ছে করলে তাদের প্রবৃদ্ধিকে আরও বাড়ানোর জন্য জায়গায় জায়গায় বাটা সার্ভিস সেন্টার খুলতে পারে। যেখানে আমাদের শিক্ষিত বেকারদের কাস্টমার কেয়ার ম্যানেজার পদে চাকরি হতে পারে। (এতটুকু বলার পরেই আমার ক্লাসের এক শিক্ষার্থী আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “স্যার, বাটা সার্ভিস সেন্টারে কাস্টমার কেয়ার ম্যানেজারের কাজ কি হবে”? আমি বলেছিলাম, “মোবাইল ফোনের কাস্টমার কেয়ার সেন্টারে কাস্টমার কেয়ার ম্যানেজার কি করে? তখন সে উত্তর দিল, “মোবাইল ঠিক করে”। তখন আমি বলেছিলাম বাটার সার্ভিস সেন্টারে একই কাজ করবে। সেই সার্ভিস সেন্টারে কাস্টমার কেয়ার ম্যানেজাররা ক্রেতাকে জুতা মেরামত এবং জুতা পলিশের সেবা প্রদান করতে পারে।)

বাটা কোম্পানীর যখন দেখলো তাদের বিরাট একটা পূঁজি চামড়াতে বিনিয়োগ করতে হয়, তাছাড়া বিভিন্ন ট্যানারি থেকে যে প্রক্রিয়াজাত চামড়া পাওয়া যায় তা অনেক সময় মানসম্মত হয় না; তাই তারা সাভারে একটা বড় ধরনের নিজস্ব ট্যানারি প্রতিষ্ঠা করেছে। এটা হচ্ছে তাদের ব্যাকওয়ার্ড ইন্টিগ্রেশন বা  লিংকেজ।  অর্থাৎ কোম্পানিটি ভার্টিক্যাল ইন্টিগ্রেশনের মাধ্যমে তাদের প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। তবে বাস্তবে পরিপূর্ণ ভার্টিক্যাল ইন্টিগ্রেশন প্রায় অসম্ভব। বিশেষকরে সরবরাহকারীদের উপর নির্ভর না করে ব্যবসা পরিচালনা মোটেই সম্ভব নয়। যে মিষ্টি বিক্রেতা দুধের সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য ডেইরি ফার্ম দিবে সে তখন দেখবে পশুখাদ্য সরবরাহকারী বিভিন্ন ধরনের ঝামেলা সৃষ্টি করছে। তখন তাকে একটি পশু খাদ্য উৎপাদনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। তাছাড়া ঘাস উৎপাদনের জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। ঘাস উৎপাদন করতে গেলে দেখা যাবে ঘাসের বীজ এবং সার বিক্রেতা ঝামেলা করছে। এর সমাধান হচ্ছে একটি বীজের খামার এবং একটি সার কারখানা নিজে তৈরি করা। সার কারখানা তৈরি করার পরে দেখা যাবে গ্যাস কোম্পানি ঝামেলা করছে। অর্থাৎ এই সমস্যাটি কখনোই শেষ হবে না । এক সময় আমেরিকান গাড়ি প্রস্তুতকারী ফোর্ড কোম্পানির মালিকানায় ভেড়ার খামার ছিল। গাড়ির গদি তৈরি করার জন্য উল প্রস্তুত করত ঐসকল খামারে। যা আজকের দিনে চিন্তাও করা যায় না। ১৯০৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ফোর্ড কোম্পানির গাড়ি এখন পৃথিবীর দশ-বারোটা দেশে পার্ট বাই পার্ট তৈরি হয়, এক জায়গায় এসে সংযোজিত হয়। বর্তমান যুগ হচ্ছে স্পেশালাইজেশন ও বিশ্বায়নের যোগ। সব কাজ নিজে না করে, কম খরচে অন্যকে দিয়ে করানো সবচেয়ে লাভজনক। এমনকি কেউ যদি দুইটি কাজ অন্যের চেয়ে ভালোভাবে করতে পারে, সে ক্ষেত্রেও যে কাজটিতে সে তুলনামূলকভাবে বেশি পারদর্শী, সেই কাজটি নিজে করে, যে কাজে তুলনামূলকভাবে কম পারদর্শী সেই কাজটি অন্যকে দিয়ে করালে দুজনেই লাভবান হবে।  এটাই ডেভিড রিকার্ডোর (১৭৭২-১৮২৩) আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের তুলনামূলক খরচ তত্ত্ব (RicardianTheory of Comparative Cost)। এক্ষেত্রে সাজেশন হচ্ছে সরবরাহকারীদের সাথে সর্বোচ্চ পর্যায়ের অংশীদারিত্বের সম্পর্ক স্থাপন করা।  সরবরাহকারীরা ইচ্ছে করলে অথবা অনেক সময় অনিচ্ছাকৃতভাবে  সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে। অতএব যাদের উপর নির্ভর করতেই হবে তাদেরকে বিক্রেতা না ভেবে  ব্যবসায়ের অংশীদার  মনে করায়ই শ্রেয়। অনেকটা ‘লাইফ পার্টনারের’ মত। আর অংশীদারিত্ব সব সময় কেবলমাত্র উভয়ই লাভবান হলেই স্থায়িত্ব লাভ করে।

অপরদিকে ছোটখাটো ব্যতিক্রম বাদ দিলে কোম্পানীর সব পণ্য নিজে বিক্রি করা প্রায় অসম্ভব । এক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারীদের সহায়তা নেয়ার বা তার সাথে  অংশীদারিত্ব স্থাপনের কোন বিকল্প নেই। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে প্রতিযোগী কোম্পানীগুলো পরস্পর তীব্র প্রতিযোগিতা করলেও খুচরা বিক্রেতার একই দোকানে প্রতিযোগী কোম্পানীগুলোর পণ্য পাশাপাশি এবং জড়াজড়ি করে অবস্থান করে। ভারতে যখন কোকা কোলা এবং পেপসি কোলার মধ্যে চরম প্রতিযোগিতামূলক অবস্থা এবং বিভিন্ন কারণে দুই কোম্পানীর মধ্যে বিদ্বেষপূর্ণ সম্পর্কের অবস্থা, এমনকি মামলা-মোকদ্দমা চলছে, তখনও দেখা গেছে খুচরা বিক্রেতার ফ্রিজের মধ্যে কোকের উপড় পেপসি  শুয়ে আছে। খুচরা বিক্রেতারা সামান্য পূঁজি নিয়েও ইচ্ছে করলে পৃথিবীর এক নম্বর কোম্পানী কোকাকোলাকেও নাজুক অবস্থায় ফেলতে পারে। ধরা যাক, নীলক্ষেত মার্কেটে তিনটি দোকানে কোকাকোলা পাওয়া যায়।  যে কোন কারনেই হোক কোকাকোলার নীলক্ষেত অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত সেলস অফিসারের  সাথে দোকানদার তিনজনের সম্পর্ক খারাপ হয়ে গেল। এমবিএ পাস করে বহুজাতিক কোম্পানিতে নতুন চাকরি পাওয়া “এই সেলস অফিসারটি বেশি ‘পটর পটর’ করে এবং ইংরেজিতে ধমক দেয়”।  তিনজন দোকানদার একজোট হয়ে সেলস অফিসারকে শায়েস্তা করার জন্য কোকাকোলা বিক্রি না করার সিদ্ধান্ত নিল। বিক্রয় বন্ধের পদ্ধতি হিসাবে যেটা গ্রহণ করল সেটা হল তিন দোকানেই ক্রেতা যখন কোকাকোলা চাইবে, বলবে “ঠাণ্ডা হবে না”। সর্বশেষ দোকানে গিয়ে ক্রেতা যখন শুনবে “ঠান্ডা হবে না”, তখন সে বলবে, “ঠাণ্ডা কি আছে?” পেপসি আছে । তখন বলবে, “তাহলে পেপসিই দেন”। অর্থাৎ যে তিনজন দোকানদারের সম্মিলিত পূঁজির পরিমাণ দশ লক্ষ টাকা মাত্র,  তারা তিনজন মিলে ঠেকিয়ে  দিল পৃথিবীর সেরা কোম্পানিটিকে; যার কেবল নামটির(সুনাম) বর্তমান বাজার মূল্য ৩৬.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অতএব সম্মুখের বিক্রেতাদেরকে ব্যবসায়ের অংশীদার করতেই হবে। যাদেরকে আমরা মধ্যস্থকারবারী বলি তারা বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের সমস্যা তৈরি করে, কিন্তু তারপরও তাদেরকে অস্বীকার করার কোন উপায় নাই। কখনো কখনো উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় বাণিজ্যনীতিতে প্রশ্ন আসে, “মধ্যস্থকারবারীদেরকে উচ্ছেদ করা কী সম্ভব? উত্তর হচ্ছে, অসম্ভব। মধ্যস্থকারবারীকে উচ্ছেদ করার পরেও কোন না কোনভাবে সে আবার ফিরে আসবে। ডিজিটাল যুগে ইন্টার্মেডিয়ারির সংখ্যা কমলেও ইনফর্মেডিয়ারির সংখ্যা বাড়ছে। (অনেকটা রবীন্দ্রনাথের “মধ্যবর্তিনী” গল্পের নায়ক নিবারণের মৃত দ্বিতীয় স্ত্রী বালিকা বধূ শৈলবালার মত। অকাল মৃত্যুর পরও নিবারণ আর তার প্রথম স্ত্রী হরসুন্দরীর মধ্যে শৈলবালার অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায়নি। শৈলবালার মৃত্যুর পর, “… একদিন গভীর রাত্রে শহর যখন নিদ্রিত, নিবারণ ধীরে ধীরে হরসুন্দরীর নিভৃত শয়ন কক্ষে প্রবেশ করিল। নীরবে সেই পুরাতন নিয়ম-মত সেই পুরাতন শয্যার দক্ষিণ অংশ গ্রহণ করিয়া শয়ন করিল। … উহারা পূর্বে যেরূপ  পপাশাপাশি শয়ন করিত এখনো সেইরূপ পাশাপাশি শুইল; কিন্তু ঠিক মাঝখানে একটি মৃত বালিকা শুইয়া রহিল, তাকে কেহ লঙঘন করিতে পারিল না”)।

সমন্বিত প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য আরেকটা পথ খোলা আছে সেটাকে বলা হয় পাশাপাশি বা হরিজনটাল সমন্বয়(horizontal integration)।কোনো ব্যবসায়ী যদি তার প্রতিযোগীর ব্যবসায়টি কিনে নেয় বা যেকোনো ভাবে হোক সেটার মালিকানা গ্রহণ করতে পারে তাহলে ব্যবসায় প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব। বাটা সু কোম্পানি যদি এপেক্স ফুটওয়্যার প্রতিষ্ঠানটিকে কিনে নিতে পারে তাহলে বাটা কোম্পানির নিজস্ব বিক্রি  এবং এপেক্সের বিক্রি সমন্বয় করলে প্রবৃদ্ধি অনেক বেড়ে যাবে। তবে মনে রাখতে হবে হরিজনটাল ইন্টিগ্রেশনে প্রতিযোগী কোম্পানীর অন্য কোন ব্যবসায়কে নিজের আওতায় আনলে সেটা এ ধরনের সমন্বয়ের অন্তর্ভুক্ত হবে না।  জুতা বিক্রেতা কোম্পানী আরেকটি জুতা বিক্রেতা কোম্পানির জুতার ব্যবসায় দখল নিতে পারলেই এ ধরনের সমন্বয় সম্ভব।

সামনে-পিছনে, বাম-ডানে সব পথ যখন রুদ্ধ হয়ে যাবে অথবা বর্তমান ব্যবসায়ের বাইরে যদি কোন নতুন সুযোগ পাওয়া যায় তখন সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে প্রবৃদ্ধি অর্জনের চেষ্টা করতে হবে।  আরো সুবিধাজনক এবং উন্নততর পথের সন্ধান পাওয়া গেলে পুরনো  পথে চলা অব্যাহত রেখে অথবা সেই পথ ছেড়ে দিয়ে  নতুন পথ ধরে গন্তব্যে (প্রবৃদ্ধি) যাত্রা শুরু করা যেতে পারে। বাজার, প্রযুক্তি এবং পরিবেশের পরিবর্তনের কারণে কোম্পানিগুলোকে প্রায়ই ভিন্ন পথে প্রবৃদ্ধি(diversification growth) অর্জনের চেষ্টা করতে হয। কখনো কখনো প্রতিযোগী কোম্পানিগুলো ভ্রাম্যমান ডিফেন্স(mobile defense) অথবা বাইপাস অ্যাটাক(bypass attack) করার জন্য ডাইভারসিফিকেশনের আশ্রয় নেয়। মোবাইল ডিফেন্স বা বাইপাস অ্যাটাক হচ্ছে বাজার নেতা এবং বাজার প্রতিদ্বন্দ্বী(মার্কেট চ্যালেঞ্জার) যেখানে প্রতিযোগিতা করছে তার বাইরে গিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি ব্যবসায় করার মধ্য দিয়ে অতিরিক্ত শক্তি সঞ্চয় করা। (আমার এমবিএ ক্লাসের এক শিক্ষার্থী, যে বিবিএ তে সর্বোচ্চ ৩.৮৬ সিজিপিএ পেয়ে প্রথম হয়েছিল; সে ভীষন টেনশনে পড়ে যায়, এমবিএ চলাকালীন সময়ে। কারণ তার সাথে দ্বিতীয় স্থান অবস্থানকারীর সিজিপিএ ছিল ৩.৮৫ অর্থাৎ সিজিপিএ এর ব্যবধান মাত্র ০.০১। অতএব এমবিএ তে তার প্রথম অবস্থান নাও থাকতে পারে। এই টেনশনে সে ঘুমাতে পারছিল না। প্রথম হওয়া শিক্ষার্থী একদিন আমার কাছে এসে তার ভবিষ্যৎ কী হবে,  এমবিতেও প্রথম হওয়ার অনিশ্চয়তা  নিয়ে কান্নাকাটি শুরু করলো। আমি তাকে বললাম, “তুমি এক কাজ করো, রবীন্দ্র সংগীত শিখে নাও”। ওই শিক্ষার্থী আমাকে বললো, “স্যার, রবীন্দ্র সংগীত শিখে কি হবে?” তখন আমি বললাম, “ভবিষ্যতে কাজে আসবে; কোন কারণে যদি দ্বিতীয় অবস্থানকারী মাস্টার্সে প্রথম হয়ে যায়, তখন তোমাদের দুইজনের অবস্থান সমান সমান হবে অর্থাৎ দুজনেই একটিতে প্রথম, আরেকটিতে দ্বিতীয়। তখনই  রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিষয়টাকে সবাই তোমার অতিরিক্ত যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করবে”।)  চা উৎপাদনকারী দুইটি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানের একটি হঠাৎ করে চিংড়ি রপ্তানি শুরু করলো, এটাকে মোবাইল ডিফেন্স বা বাইপাস অ্যাটাক বলা যেতে পারে। পুলিশ অনেক সময় এই কৌশলটি গ্রহণ করে। মূল আসামীকে ধরতে না পারলে তার স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে থানায় এনে আটকে রাখে, যাতে মূল আসামি স্বেচ্ছায় ধরা দেয়।

 কোম্পানীর জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় সুযোগটি হচ্ছে যেটি তার ব্যবসায় শক্তির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তিনটি সম্ভাব্য ভিন্ন পথ খোলা আছে। কোম্পানি তার বর্তমান পণ্যের প্রযুক্তির

এবং অথবা বাজারজাতকরণের সাথে মিল আছে এমন পণ্য তৈরি করতে পারে, যদিও নতুন পণ্যটি হয়তো ভিন্ন ক্রেতা শ্রেণীর নিকট বিক্রির চেষ্টা করা লাগতে পারে। এ ধরনের কৌশলগুলোর মধ্যে প্রথমটি হল কেন্দ্রীভূত ভিন্ন পথ কৌশল (concentric diversification strategy)। সাধারণত অব্যবহৃত উৎপাদন ক্ষমতা ব্যবহার করার জন্য এ ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়। অর্থাৎ নতুন কোন কারখানা স্থাপন না করে, একই প্রযুক্তি, একই কাঁচামাল, এমনকি একই শ্রমিক ব্যবহার করে বাজারের জন্য নতুন কিছু তৈরি করা। জুতার কোম্পানি যদি চামড়ার জ্যাকেট তৈরি করে সেটা হবে কেন্দ্রীভূত ভিন্নপথে প্রবৃদ্ধির চেষ্টা। দ্বিতীয়ত, কোম্পানি যদি তার বর্তমান ক্রেতাদের নিকট আবেদনময়ী হবে এমন নতুন পণ্য তৈরি করে, এবং যদি নতুন পণ্যের প্রযুক্তি সম্পূর্ণ ভিন্ন হয় তাহলে সেটা হবে ভূসমন্তরাল ভিন্নপথ কৌশল(horizontal diversification strategy)। এক্ষেত্রে অব্যবহৃত বাজারজাতকরণ ক্ষমতাকে কাজে লাগানোর জন্য চেষ্টা করা হয়।

একটি প্লাস্টিকের বালতি এবং মগ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান যখন দেখে তাদের বিক্রয়কর্মীরা ইচ্ছে করলে আরো কয়েকটি পণ্য নিয়ে বাজারে যেতে পারে তখনই হয়তো চিন্তা করে-  বঁটি তৈরি করে যদি বালতির মধ্যে দিয়ে  দেওয়া যায় তাহলে নতুন কোন বিক্রয়কর্মী নিয়োগ দেয়া লাগবেনা। কারণ বালতি এবং বঁটি একেই দোকানে বিক্রি হয়, ক্রেতাও প্রায় একই । তবে জুতার ফ্যাক্টরিতে যত সহজে চামড়ার জ্যাকেট তৈরি করা গেছে। এক্ষেত্রে এটা সম্ভব হবে না। প্লাস্টিক কোম্পানিতে লোহার বঁটি তৈরি করা যাবে না। এর জন্য সম্পূর্ণ একটি ভিন্ন ফ্যাক্টরি তৈরি করতে হবে। এমনকি বিক্রেতা যদি দেখে বালতির মধ্যে আরো জায়গা খালি আছে যেখানে ঝাড়ু নিয়েও যাওয়া যায়, তখন হয়তো সে নোয়াখালীর চরাঞ্চল থেকে ফুলের ঝাড়ু কিনে এনে তার বিক্রয় কর্মীদের হাতে দিবে। কারণ ফুলের ঝাড়ুও হার্ডওয়ারের দোকানে বিক্রি হয়। অর্থাৎ এক্ষেত্রে নতুন করে উৎপাদন ব্যবস্থা সৃষ্টি করা লাগলেও মার্কেটিং ব্যবস্থাটা একই থাকবে। পার্টিকেল বোর্ড উৎপাদনকারী যদি স্যানিটারি সামগ্রী উৎপাদন করে তবে সেটাও হবে ভূসমান্তরাল বা পাশাপাশি ভিন্ন পথ। স্যানিটারী সামগ্রী ও পার্টিকেল বোর্ডের ব্যবহারকারী  বাড়ী নির্মাতা বা মেরামতকারী হলেও পণ্য দুটির উৎপাদন প্রযুক্তি সম্পূর্ণ ভিন্ন, তবে বিক্রি হয় কাছাকাছি দোকানে বা একই মার্কেটে ।

 কোম্পানির বর্তমান প্রযুক্তি, পণ্য অথবা বাজারের সাথে কোন মিল নেই, অথচ লাভজনক হবে এমন যে কোন ব্যবসায় আরম্ভ করলে সেটাকে  বহু-সমন্বিত বা conglomerate(পিণ্ডীভূত) ভিন্নপথ কৌশল বলা হয়। অর্থাৎ এক্ষেত্রে উৎপাদন ব্যবস্থার সামঞ্জস্যতা অথবা বাজারের মিল থাকা, ইত্যাদি কোন বিষয় বিবেচনায় আনা হবে না। বিবেচ্য বিষয় হবে একটাই, ব্যবসাটি  লাভজনক কিনা। যে কোম্পানী একসময় বিড়ি বিক্রি করতো সেই হয়তো একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করছে। সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রোডাক্ট ‘বিড়ি’ আর ‘এমবিএ’। কাস্টমারও সম্পূর্ণ ভিন্ন। খুব সম্ভবত যারা এমবিএ পড়ে তারা বিড়ি খায় না; শ্রমিকও ভিন্ন। একটি পণ্য ভিত্তিক, আরেকটি সেবা ভিত্তিক ব্যবসায়। কোন দিক দিয়েই মিল নাই, শুধু একটাই বিবেচনা, বিড়ির চেয়ে এমবিএ বিক্রির ব্যবসা অনেক বেশি লাভজনক,  কারন অনেকেই বিড়ি-সিগারেট ছেড়ে এমবিএ কে আঁকড়ে ধরছে। টাটা, মিৎসুবিশি, প্রাণ, নাসির, এসিআই, বসুন্ধরা, মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ এ ধরনের conglomerate বিজনেস হাউজের উদাহরণ।

(লেখকঃ উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং আহ্বায়ক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম)


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ
এক ক্লিকে বিভাগের খবর