২১শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, রবিবার, ভোর ৫:৫৭
শিরোনাম :
শিরোনাম :
অমর একুশে বইমেলায় মনোয়ার মোকাররমের “আগামী বসন্তে” আজ বঙ্গবন্ধু গবেষক মিল্টন বিশ্বাসের জন্মদিন কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় এপার-ওপার বাংলার লেখকগণ জবিতে ‘মধুসূদন ও বাংলা সাহিত্য’ শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত দীনেশচন্দ্র সেনের বৃহৎবঙ্গ, বাংলার লোককৃষ্টির যুক্ত সাধনার ঐতিহ্য আলোচনা সভার প্রধান আলোচক মিল্টন বিশ্বাস স্বর্ণপদক পাচ্ছেন কথাসাহিত্যিক নাসরীন জেবিন যারা কবিতা ভালোবাসে তারা স্বচ্ছ মানসিকতার হয় : কবি কামাল চৌধুরী ফাঁসিতলা ক্লাব ও পাঠাগারের কার্যনির্বাহী কমিটির সাথে সাংসদ মনোয়ার হোসেন চৌধুরীর শুভেচ্ছা বিনিময় ফাঁসিতলা ক্লাব ও পাঠাগারের প্রথম কার্যনির্বাহী সভা অনুষ্ঠিত ‘‘সাহিত্যে দুই মহামানব : গান্ধী ও বঙ্গবন্ধু’’ বিষয়ক আন্তর্জাতিক আলোচনা চক্রটি অনুষ্ঠিত
নোটিশ :
Wellcome to our website...

ব্লাসফেমী আইন এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

মোঃ আব্দুল বাকী চৌধুরী নবাব
রবিবার, ২১ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:৫৭ পূর্বাহ্ন

অ) দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ইসলাম ধর্মকে অ্যাট্যাক করে ঘটনা বা নেতিবাচক বিবৃতি ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি। কিন্তু কেন এ হীনমনতা, এ প্রশ্নের জবাব বিশ^ বিবেকের আদালতে রাখতে বাধ্য হচ্ছি? ইদানীং (১৩/১০/২০২১ইং) ঘৃণিত যে ঘটনাটি ঘটেছে, সেটা আমাদেরই দেশের কুমিল্লার নানুয়া দিঘীর পাড় দুর্গা পূজা মন্ডবে গনেশের পায়ের কাছে পবিত্র কোরআন শরীফকে রেখে অবমাননা। এর জের হিসেবে কয়েকজন ধর্মীয় প্রাণও শহীদ হয়েছে এবং ভাংচুরও কম হয়নি। অবশ্য বর্তমান সফল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়ের তাৎক্ষণিক সরাসরি হস্তক্ষেপের সুবাদে সারাদেশে না ছড়িয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে এসেছে। যাহোক, এটি ষড়যন্ত্র বা চক্রান্ত বা অন্য কিছুই হোক না কেন, এই পবিত্র ধর্মগ্রন্থ নিয়ে এহেন দুঃখজনক ঘটনা ঘটবে কেন? শুধু এই ঘটনা নয়। ইসলাম ধর্মকে ঘিরে স্বয়ং মুসলমান হয়েও তসলিমা নাসরিন ও সালমান রুসদির মতো জ্ঞানপাপী মানুষ কম টানা হেঁচড়া করেননি? এই তো কয়েকমাস আগে আমাদের প্রাণ প্রিয় নবী করিম (সঃ)কে নিয়ে ফ্রান্সে নানা রকম ব্যঙ্গচিত্র তৈরিপূর্বক সোশ্যাল মিডিয়ার বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। অবশ্য সেই ব্যঙ্গচিত্রকারক কিছুদিন আগে দুর্ঘটনায় অকাল মৃত্যু হয়েছে। যাহোক, ইসলাম শান্তির ধর্ম। আর এ ধর্মের ভ্যালুস এতটাই সমুন্নত বাস্তবধর্মী এবং বিজ্ঞানসম্মত যে এমন দিন নেই যে অন্য ধর্ম থেকে মানুষ ইসলাম ধর্মে দিক্ষিত হচ্ছেন না? এর সপক্ষে পাক-বাংলা-ভারত উপমহাদেশের কথা বাদই দিলাম, স্বয়ং ইউরোপ মহাদেশের জার্মানী দেখলে সহজে জবাব মিলে যায়। সত্যি কথা বলতি কি, ধর্মকে নিয়ে এত বাড়াবাড়ি আগেও ছিল, এখনও আছে এবং হয়তো আগামীতেও থাকবে। তবে এর একটি সুরাহা হওয়া অপরিহার্য বলে মনে করি। ধর্মকে অবমাননাকে নিয়ে একটি বিশেষ আইন আছে, যার নাম “ব্লাসফেমি আইন”। আর বিশ্বে এর কার্যকারিতা কতখানি আছে, সে বিষয়ে অনেকে সংশয় পোষন করে থাকেন। তাই সংগত কারণেই এ সম্পর্কে সম্যক ধারণার জন্য নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করার প্রয়াসী হয়েছি।
আ) আমি আইনের উপর এক বছর সেন্ট্রাল ল কলেজে পড়াশুনা করেছিলাম। তৎপর বিভিন্ন কারণে আর আইন পড়া হয়নি। পড়ার প্রাক্কালে রোমান আইন খুব ভাল লাগতো এবং আইন বিজ্ঞান তেমন ভাল লাগতো না। যাহোক, তখন হতে আইন সম্পর্কিত কোন বিষয় খবরের কাগজে দেখলে খুব মনোযোগ সহকারে পড়ে থাকি। এই তো কিছুদিন আগে পত্রিকায় ব্লাসফেমী আইন সম্পর্কে কিছু বিষয় চোখে পড়েছিল। সেই সময় এ সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা পেতে আইনের মেধাবী ছাত্রসহ কয়েকজন স্বনামধন্য বিজ্ঞ উকিলকে জিজ্ঞাসা করে কোন সদোত্তর পাইনি। কিন্তু আমি বসে থাকিনি। নীলক্ষেত ও আজিজ মার্কেটসহ নানা মার্কেট থেকে বিভিন্ন বইপত্র যোগাড় করে পড়াশুনা করে এই আইন সম্পর্কে সংগত কারণেই লিখায় ব্রতী হয়েছি। কেননা আমি মনে করি যে শিক্ষিত মহলসহ সবাইকে এটি জানা দরকার। নতুবা ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হওয়ার অবকাশ থাকতে পারে।
ই) কথায় বলে সাধারণ জ্ঞানই আইন এটি পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মিথস্ক্রিয়ার সূত্র ধরে বিভিন্ন জনপদ থেকে উঠে আসে এবং ঘটনা প্রবাহে এর দিক-নির্দেশণা দিয়ে থাকে। তাছাড়া নজিরও অনেক সময় আইনের আওতায় আসে। এদিকে জ্ঞানের বিকল্প নেই। কেননা জ্ঞান আহরনের মাধ্যমে পরিপূর্ণতা আসে এবং দৃষ্টিভঙ্গি অনেক বেড়ে যায়। তাই বিভিন্ন আইনের বই ঘেঁটে এবং যুগপৎ ব্লাসফেমী আইন সম্পর্কে বিভিন্ন স্থান হতে তথ্যাদি সংগ্রহপূর্বক এটি লিখতে প্রয়াসী হয়েছি। জানি না আমার এই আর্টিকেলটি সম্মানিত পাঠকদের কতটুকু উপকারে আসবে? এই আইনটি মূলতঃ ব্রিটিশ আইনের Common Law Misdemeanor থেকে উদ্ভব হয়েছে। সেই সময়ে খৃীষ্টিয় ধর্মবিদরা ব্লাসফেমী (ঈশ্বর নিন্দা) পাপ হিসেবে গণ্য করতেন। তখন এ প্রেক্ষাপটে স্বয়ং সেন্ট থমাস একুইনাস এটিকে বিশ্বাসের বিরুদ্ধে পাপ হিসেবে মনে করতেন। সাধারণত যে সকল অবমাননাকর বিবৃতি বা রচনা বা ঘটনা , যা ধর্মীয় গ্রন্থ বা স্রষ্টা বা এ ধরনের সমজাতীয় বিষয়াদির উপর আঘাত হানে ও অমর্যাদা করে তুলে। তখন সেটি ব্লাসফেমী আইনের আওতায় পড়ে থাকে। এটি দন্ডবিধি ২৯৫(ক) ধারা মোতাবেক ইচ্ছাকৃত ও বিদ্বেষমূলক ভাবে কোন সম্প্রদায় বিশেষের বিরুদ্ধে ধর্মাবমননা দন্ডনীয় অপরাধ। বস্তুত ব্লাসফেমী শব্দটি বিশেষ্য , এর আদি শব্দ হলো ক্রিয়া ব্লাসফেমী, যার অর্থ- ‘ To use words which show a lack of respect for God or Religion or Swear (CAMBRIDGE Advanced Learner’s Dictionary). এদিকে উইকিপিডিয়ায় এ সম্পর্কে সুন্দর ভাবে একটি সংজ্ঞা আছে যেমন- Blasphemy is the defamation of the name of one or more Gods. These include using sacred as stress expletives without intention to pray or speak of sacred matters. Sometimes blasphemy is used loosely to mean any profane language. উল্লেখ্য যে, হযরত মুসা (আঃ) এর সময়ে এই ধরনের মোজাইক আইনে নাকি মৃত্যুদন্ডের বিধান ছিল। এদিকে প্রখ্যাত রোমান সম্রাট জাষ্টিনিয়ান (প্রথম) এই অপরাধের জন্য মৃত্যু দন্ড দিতেন। অষ্টাদশ শতাব্দি পর্যন্ত স্কটল্যান্ডে এতদ্বিষয়ে মৃত্যুদন্ডের নিয়ম ছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে ব্লাসফেমীর জন্যে গুরু দন্ডের নিয়ম ছিল। আসলে তৎকালীন সময়ে এই বিষয়টি তালগোল পাকিয়ে ধর্মের উপর আঘাত হানাকে দেশের সার্বভৌমত্বের (তথা রাজা-রানী) বিরুদ্ধাচরণ বলে পরিগণিত হতো। তখন রাজা বা রানীকে ঈশ্বরের ছায়া বলে গণ্য করা হতো বিধায় ঈশ্বরের ইচ্ছা নাকি রাজা বা রানীর ইচ্ছা এবং এটি সমানে রেখে অনেক নেতিবাচক কাজ করা হতো। তাছাড়া এক্ষেত্রে চার্চের আওতায় ইনকুইজিশন আদালতও প্রণিধানযোগ্য। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে রাষ্ট্র সবার, কিন্তু ধর্ম একান্ত নিজস্ব ব্যাপার। তথাপিও অতীতে অনেক দুঃখজনক ঘটনা ঘটে, যার শিকার হয়েছেন গ্যালিলিওসহ অনেক বড় বড় মনীষী। আসলে এই ধারণা আরব তথা মুসলিম দেশের নয়, এটি মধ্যযুগীয় খ্রীষ্টানদের ধারণা। একটি মজার ব্যাপার হলো যে ব্লাসফেমী এমন একটি আইন, যাতে অপরাধের নিমিত্তে ক্রিমিনাল ইনটেশন প্রমান করার আবশ্যকতা নেই। যতদূর জানা যায় যে, বর্তমানে পাকিস্তান ব্যতীত অন্য কোথায়ও এই আইনের প্রয়োগ নেই। বাংলাদেশে নাকি উদ্যোগ গ্রহণ করেও মাঝ পথে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এদিকে পশ্চিমা বিশ্বের কিছু কিছু দেশ যেমন- অস্ট্রিয়া, ডেনর্মাক, ফিনল্যান্ড, ইত্যাদি দেশে এই আইনের অনেক পরিবর্তন করা হয়েছে এবং শুধু ধর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি। উল্লেখ্য যে, পাকিস্তানে এই আইনের প্রবর্তন ও বাস্তবায়ন শুরু হয় তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হকের আমল থেকে। এ পর্যন্ত এই দোষে দোষী করে ৪ জনকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে। যতদূর জেনেছি, এগুলো ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে শত্রুতামূলক ভাবে করা হয়েছে। আমরা যদি খৃষ্টান জগতের দিকে তাকাই, তাহলে দেখি এই দোষের জন্য বিগত একশত বছরে মাত্র ৬টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। তাই বর্তমানে এই আইন প্রায় বিলুপ্তির পথে। তা না হলে Jesus Crist Super Star এবং The last Temptation of Christ শিল্পকর্ম খৃষ্টান ধর্মের উপর আঘাত হানলেও কোন মামলা দায়ের করা বা এমনকি নিন্দাও করা হয়নি। এর সূত্র ধরে যদি দেখি, তাহলে প্রতীয়মান হয় যে পরোক্ষভাবে পশ্চিমাদের ছত্রতলে থেকে মিঃ রুশদি ও তসলিমা নাসরিন বহাল তবিয়তে খোলা আকাশের নিচে রোদ ও ঝড়-বৃষ্টি থেকে মুক্ত আছে। আর এদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে তাদেরকে মৌলবাদ বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে।
ঈ) আমি জীবনের প্রথমে পরিবার পরিকল্পনা অফিসে চাকুরি করতাম এবং এরই সুবাদে বাংলাদেশের জনপদের অলিগলিতে ঘুরে বেড়াতে হতো। এই পরিবার পরিকল্পনার বিষয় সাধারণ মানুষকে বুঝাতে গিয়ে অনেক সময় নাজুক পরিস্থিতিতে পড়তে হতো। কিন্তু আমি মনে প্রাণে বিশ^াস করতাম বাংলার মানুষগুলো ধর্মভীরু এবং সহজ সরল, যা একবার বুঝে, তা থেকে সরিয়ে আনা কষ্টসাধ্য। তাই যখন আমি পরিবার পরিকল্পনার Conception & Contraception এর কথা কিছুটা ঘুরিয়ে বলতাম। যেমন- আজল প্রথা ও কয়েল পদ্ধতি আরব দেশ থেকে এসেছে। তখন ধর্মপ্রাণ মানুষের মধ্যে বেশ কাজ হতো, যার ফল অদ্যাবদি আসছে। অথচ এই মানুষগুলোকে পশ্চিমা বিশ^ কয়েক ধাপ নিচে নামিয়ে নিয়ে মৌলবাদী নাম দিয়েছে। তখন শুধু কষ্টই হয় না, অন্তরেও খুব ব্যাথা লাগে। যাহোক, এবার আসল কথায় পুনরায় আসা যাক, ব্লাসফেমী আইন কানুনের প্রেক্ষাপটে ইসলামের দর্শনের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে সহজেই বুঝা যায়। নবী করিম (সঃ) দৃঢ়তার সাথে বলেছিলেন, ‘তোমরা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করিও না, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি অনেক জাতির ধ্বংসের কারণ হয়েছে’। তাছাড়া সহনশীলতা ও মুক্ত স্বাধীন চিন্তার কথাও বলা আছে এবং ধর্মের ব্যাপারে কোন জোর-জবরদস্তি নেই। তবে তখন দুঃখ হয়, যখন দেখি দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে কিছু মিশনারি গরীব মানুষদের অন্যধর্মে দীক্ষিত করছে। অনেক সময় দেখা যায় অতি উচ্ছ্বাস ও ভুল বুঝাবুঝির জন্যে অনেক মহামানবের যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়নি। যার কারণে ইসলামী চিন্তাবিদ ইমাম গাজ্জালী (রঃ), বিজ্ঞানী ইবনে সিনা, কবি নজরুল ইসলাম প্রমুখ অধিব্যক্তিকে কম নাজেহাল হতে হয়নি? পুনঃউল্লেখ্য যে, সনাতন ধর্ম বা খৃষ্টান ধর্ম বা বৌদ্ধ ধর্ম বা উপজাতীদের ধর্মই হোক না কেন, কোন ধর্মেই পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে যে বøাসফেমীর জন্য গুরুদন্ড তথা ফাঁসি দিতে হবে, এমন কথা নেই। এদিকে সর্বশেষে শান্তির বারতাপুষ্ঠ ইসলাম ধর্মে সহিষ্ণুতার উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কারো মত বা চিন্তাধারা ধর্মীয় দর্শনের সাথে অমিল হলে হত্যা করতে হবে তার উল্লেখ নেই। বার বার সহনশীলতা, ধৈর্য্যের কথা বলা হয়েছে। সাধারণত অহংকার, সীমাবদ্ধ জ্ঞান ও স্বার্থপরতার কারণে ধর্ম নিয়ে ঝগড়া-ঝাটি হয়ে থাকে। উল্লেখ্য যে, ধর্ম অস্বীকারকারী বা বিদ্রæপকারীকে দন্ড প্রদান কিম্বা ক্ষমা প্রদর্শন মানুষের আওতায় নয়, এটি স্বয়ং আল্লাহ তা’লার এখতিয়ারভুক্ত। পবিত্র কোরআনে মুক্তচিন্তা ও ধর্ম পালনে স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে সূরা বাকারা প্রত্যক্ষ করলে দেখা যায় যে, ধর্মের ব্যাপারে কোন প্রকার জোর জবরদস্তি নেই।
উ) সত্যি কথা বলতে কি, আদি হতে সব সৃষ্টিই স্রষ্ট্রাকে খুজে বেড়াচ্ছে। কেউ সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পেরেছেন কি না, তিনিই জানেন। আর তল্লাশীর পথটি ধরে ধর্ম সংস্কারকের কথাও উঠে এসেছে। অবশ্য পথ মধ্যে অনেকে আচার ভিত্তিক কর্মকান্ড গড়ে উঠেছে। এদিকে মানুষ সত্যসন্ধানী, চিন্তাশীল ও পরিবর্তনের প্রত্যাশী। যেমন, সূর্য ঘুরে না পৃথিবী ঘুরে, এ নিয়ে গোড়াতে অনেককে নাজেহাল হতে হয়েছে এবং এ সূত্র ধরে বেচারা কোপারনিকাসের সাধের বইটি পর্যন্ত নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তাছাড়া ডিম আগে না মুরগী আগে, তা নিয়ে তর্কের শেষ নেই। বস্তুত দর্শন অনুযায়ী ধর্ম কোন স্থুল বিষয় নয়, সম্পূর্ণ সূক্ষ্ণ; যা মননশীলতা ও পবিত্রতার উপর নির্ভরশীল। মানুষ এই মুহূর্তে যা ভেবে সিদ্ধান্ত নেয়, পরমুহূর্তে পরিবতন করে থাকে। আর আত্মকেন্দ্রিকতা তো আছেই এবং নিজেকে নিয়ে ভাবে এটি আমার, ওটি আমাদের, ইত্যাদি। এই যে আমার বা আমাদের কথা বলে ও একই সাথে তার উপর গুরুত্ব দিয়ে করে থাকে এবং যার ফলশ্রুতিতে মধ্যম পুরুষ ও প্রথম পুরুষের গুরুত্ব তুলনামূলকভাবে কমে যায়। তাছাড়া এই বিষয়টি অন্ধদের হাতি দেখার মতো। অন্যগুলো ভাল হলেও ভাল বলে না অথবা ভাল চোখেও দেখে না এবং তেমন গুরুত্বও দেয় না। যার যার ধর্ম তার কাছে উত্তম। আবার দেখা যায় যে আজকে যারে মন্দ বলছে, কালকে ভাল বলে এবং পরশু কাছে টেনে নেয়। তাই আজ কটুক্তি করলে কালকে ভালোবাসে, যার ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে। কেউ সারা জীবন কোন ধর্ম-কর্ম করেনি, শুধু অন্যায় করেছে এবং কটুক্তি করতেও দ্বিধাবোধ করেনি। পরিশেষে তিনি জবরদস্থ অলি বা সাধু বনে গিয়েছে। তাই সুধী মহলের কাছে একান্ত অনুরোধ ব্লাসফেমী নিয়ে টানাটানি না করে আমাদের সীমিত জীবনকালকে ভাল কাজে ব্যয় করি। স্রষ্টার এবাদত ও সৃষ্টের সেবা করি, যার উপর কোন ধর্ম নেই। আর কোন ধর্ম সম্বন্ধে কুৎসা বা নিন্দা বা কট‚ক্তি বা নেতিবাচক ঘটনা করার আগে নিজের কাছে প্রশ্ন করতে হবে, নিজ ধর্মই হোক বা অন্য ধর্মই হোক, সে সম্পর্কে কতটুকুই বুঝি বা জানি? কেননা ধর্মের সর্বশেষ উদ্দেশ্য হচ্ছে পঞ্চ মাত্রার আওতাভুক্ত সূক্ষ্ণ বিষয়। তাছাড়া স্বয়ং বিধাতা বলেছেন, ‘আমি যা জানি, তোমরা তা জানো না।’ তাই ব্লাসফেমী আইনের আওতাধীন বিষয় বা ঘটনা সম্পর্কে অতি সতর্কে কথা বলা বা সাবধানে পা ফেলতে হবে। কেননা যে কোন সময় পরপারে ডাক পড়তে পারে। এদিকে আমরা কুমিল্লার নানুয়া দিঘিরপাড় পূজা মন্ডপের ন্যায় দুঃখজনক ঘটনা দেখতে চাই না এবং রুশদী ও তসলিমা নাসরীনরা যেন আর না জন্মায় সেদিকে সদা ঈগল দৃষ্টি রাখি। আর এই ব্লাসফেমী আইনের আওতায় টেনে এনে বাস্তব কোন লাভ হবে কিনা সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
উ) এখানেই শেষ নয়, অধুনা ভারতের তামিল নাড়–র একটি মন্দিরে গো মাংস রাখায় সেখানের পরিস্থিতি অস্থির হয়ে উঠেছে। এদিকে পূর্বেই বলেছি যে, বাংলাদেশের কুমিল্লার পূজা মন্ডবে দুষ্কৃতিকারক কর্তৃক পাক-কোরআন রাখায় পরিস্থিতি এমনই নাজুক হযেছে যে, কয়েকজনের মৃত্যুসহ দেশের কিছু কিছু স্থানে আগুন দেয়া এবং ঘরবাড়ী ভাংচুর করা হয়েছে। এটা আর কিছু নয়, সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের আড়ালে বিদ্বেষ ও জাতিভেদের দিকে এগিয়ে দেয়ার পথ উম্মোচন করার নামন্তর মাত্র। এই ধরনের ঘটনার সূত্র ধরে ব্রিটিশ ভারতের সিপাহী বিদ্রোহের কথা মনে পড়ে যায়। এই বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল সিপাহী কর্তৃক ব্যবহৃত আগ্নেয় অস্ত্রের গুলিতে (টোটা বা কার্টিজ) গরু এবং শুকরের চর্বি ব্যবহার। এতে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সিপাহীদের ধর্মীয় ভ্যালুসের উপর আঘাত হানে। সেহেতু অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে, আমার বোধ হয় আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকারে পরিণত হতে চলেছি। তাই এটি খন্ড খন্ড নেতিবাচক ঘটনা মনে না করে, এর উপর অধিক গুরুত্ব আরোপপূর্বক ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে আমাদের সর্বাদিক থেকে তৎপর হতে হবে। নতুবা এর পরিনতি যে কি হবে, তা সহজেই অনুমেয়?

সূত্রাদি ঃ

১। সংলাপ (অক্টোবর,১৯৯৪ সংখ্যা-৩)
২। CAMBRIDGE Advanced Learners Dictionary
৩। আইন শব্দকোষ- মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ও আনিসুজ্জামান
৪। উইকিপিডিয়া।
৫। ব্লাসফেমী আইন, গণতন্ত্র ও সভ্যতা বিরোধী- খালেকুজ্জামান
৬। মানবকণ্ঠ- ১৫/১০/২০২১ইং।
৭। সংশ্লিষ্ট গুণীজনের সাথে আলোচনা।
৮। ইউটিউব-১৮/১০/২০২১ইং, ইত্যাদি।

 

মোঃ আব্দুল বাকী চৌধুরী নবাব-বিশিষ্ট গবেষক, অথর্নীতিবিদ এবং লেখক হিসেবে বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্মাননা ও পদকপ্রাপ্ত।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ
এক ক্লিকে বিভাগের খবর