মো. আহসান হাবিব।।
কোটি মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় জায়গা নেয়া প্রিয় গানের পাখি এন্ড্রু কিশোর জীবনের অত্যন্ত খারাপ সময় অতিবাহিত করছেন। তিনি জীবন- মরণের এক কঠিনতম বাস্তবতার সম্মুখীন। ২০১৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর উন্নত চিকিৎসা নিতে পাড়ি জমান সিংগাপুরে। কিডনি ও হরমোনজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন। ফলে শরীরের ওজন ক্রমশ হ্রাসসহ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। বড় হয়েছিল এড্রেনাল গ্লান্ড। নানবিধ সমস্যার পাশাপাশি ছিল জ্বর। কোনো সময়ের জন্য সে জ্বর ছাড়তই না। চিকিৎসকরা শরীরের কিছু নমুনা বায়োপসির জন্য ল্যাবে পাঠিয়েছিলেন। রিপোর্টে- প্লেব্যাক সম্রাটের ক্যন্সার ধরা পড়ে। সিংগাপুরে কেমো দেয়ার ব্যবস্থা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর চিকিৎসায় সহায়তাও করেছেন। প্রথম পর্যায়ের চিকিৎসা শেষে তিনি দেশে ফিরেছেন ২০২০ সালের জুন মাসে। কোটি মানুষের প্রিয় এই সংগীতশিল্পী জন্মস্থান রাজশাহীতে বর্তমানে অবস্থান করছেন। ক্রমশ অবনতির দিকে ধাবিত শরীর-মন নিয়ে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে তিনি।
২.
৪ নভেম্বর ১৯৫৫ পিতা ক্ষীতিশ চন্দ্র বাড়ৈ ও মাতা মিনু বাড়ৈয়ের সংসার আলোকিত করে উপমহাদেশের ‘স্বর্ণকণ্ঠ’খ্যাত সংগীত জগতের জীবন্ত কিংবদন্তি এন্ড্রু কিশোরের পৃথিবীতে আগমন ঘটে। জন্মস্থান রাজশাহীতেই তিনি বেড়ে ওঠেন। শিক্ষিকা মায়ের কাছেই তাঁর শিক্ষা জীবনের হাতেখড়ি। সংগীতমনা মা প্রিয় শিল্পী কিশোর কুমারের ভক্ত ছিলেন। তাইতো প্রিয় শিল্পীর নামের সঙ্গে মিল রেখেই নিজের সন্তানের নাম রাখেন এন্ড্রু কিশোর। মা মিনু বাড়ৈয়ের ভাবনাতে কখনই প্রস্ফুটিত হয়নি -যে তাঁর সন্তান একদিন প্রিয় শিল্পী কিশোর কুমারের মতো খ্যাতি অর্জন করবেন। সেদিনের ছোট্ট শিশুটিই আজ বাংলাদেশের চলচ্চিত্র গানের প্লেব্যাক সম্রাট।
শৈশব থেকেই সংগীতের প্রতি প্রবল আগ্রহ তাঁর। তাঁর কাছে জীবনই সংগীত, সংগীতই জীবন। আব্দুল আজিজ বাচ্চুর সান্নিধ্যেই তাঁর সংগীতচর্চার সূচনা। স্বাধীনতার পর তিনি নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, দেশাত্মবোধক, লোক, আধুনিকসহ অনেক গানে রাজশাহী বেতারের নিয়মিত শিল্পী হিসেবে নিজেকে অন্তর্ভুক্তি করান।
এন্ড্রু কিশোরের সবচেয়ে জনপ্রিয় গানের মধ্যে – জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প, আমার সারা দেহ খেয়ে গো মাটি, হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস, ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে, আমার বুকের মধ্যে খানে, পৃথিবীর যত সুখ আমি তোমার ছোঁয়াতে খুঁজে পেয়েছি, সবাই তো ভালোবাসা চায়, বেদের মেয়ে জোসনা আমায় কথা দিয়েছে, তুমি আমার জীবন আমি তোমার জীবন, চোখ যে মনের কথা বলে, তুমি মোর জীবনের ভাবনা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। শিল্পীর জীবনের অবিস্মরণীয় গান ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’। গানটির জন্যই প্রথমবার ১৯৮২ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। সর্বোমোট আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন গুণী এই শিল্পী। গান গেয়ে চার দশকেরও বেশি সময় ধরে সংগীতপ্রেমীদের মন জয় করে আসছেন এই প্লেব্যাক সম্রাট। আশির দশকে প্লেব্যাকের জগতে পা রাখার পর থেকেই তিনি বাংলা, হিন্দিসহ বহু চলচ্চিত্রের গানে মধুমাখা কণ্ঠ দিয়েছেন।
এন্ড্রু কিশোরের গানগুলো অত্যন্ত জীবনঘনিষ্ঠ। মানুষের নানাবিধ দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা ক্ষণিকের জন্য ভুলিয়ে সুখের পরশ দেয় তাঁর গান। জীবন ও সংগীতের যে এমন চমৎকার মেলবন্ধন সেটি তাঁর গানে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একজন শিল্পী কণ্ঠের জাদু এবং নিজের কষ্ট দিয়ে কোটি মানুষের কষ্ট ভুলিয়ে দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টায় নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। এক্ষেত্রে এন্ড্রু কিশোরও ব্যতিক্রম নন। অতীতকে ভুলে নতুন করে বাঁচার আশা জাগায় তাঁর গান। এমন একটা সময় ছিল যখন বেতার এবং বাংলা সিনেমা মানুষের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ছিল; সেই বেতার ও বাংলা সিনেমা এন্ড্রু কিশোরের গানে মুখর হয়ে থাকত। এককথায় সারাদেশে তিনি সুরের জাল বিস্তার করেছিলেন। এমনকি একটা সময় প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন বাংলা গানের।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট বিভাগের কৃতি শিক্ষার্থী এন্ড্রু কিশোর শুধু দেশবরেণ্য সংগীতশিল্পীই নন, একজন ব্যবসায়ীও বটে। ১৯৮৭ সালে তিনি আহমাদ ইউসুফ, আনোয়ার হোসেন বুলু, দিদারুল আলম বাদল, ডলি জহুর, শামসুল ইসলাম নান্টুর সাথে টিভি নাটক, বাণিজ্যিক এবং অন্যান্য প্রযোজনার জন্য ‘প্রবাহ’ নামে একটি বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠান শুরু করেন। ব্যক্তিগত জীবনে তাঁর দুটি সন্তান রয়েছে। প্রথম সন্তানের নাম সপ্তক, দ্বিতীয় সন্তানের নাম সংজ্ঞা।
বিংশ শতাব্দীতে এন্ড্রু কিশোরের গান দেশের সংগীতাঙ্গনে নতুন ধারার সূচনা করে। তাঁর গান আজও মানুষের মুখে মুখে। গুণী এই শিল্পীর বিলাসী জীবনযাপনের সুযোগ ও সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও জাঁকজমক ও আড়ম্বরপূর্ণ জীবন উপভোগ না করে বরং খুব সাধারণ ও সৎ জীবনযাপন করে যাচ্ছেন।
প্রেম, বিরহ,রোমান্টিকতা, আধ্যাত্মিকতা, দেশপ্রেম সবই ফুটে উঠেছে তাঁর গানে।এন্ড্রু কিশোর যেন গানের অফুরন্ত ভাণ্ডার। অত্যন্ত দুঃখ করেই বলতে হয়, ইদানিং আমাদের দেশে শিল্পীর নিজস্ব গাওয়া গান স্বাভাবিক বা সাবলীল ভাবে না গেয়ে তা বিকৃত করে গাওয়া হচ্ছে। যা শুধু শিল্পীকেই নয়, সমগ্র সংগীতাঙ্গনকেই ব্যথিত করে। গত ২ জুলাই(২০২০) প্রিয় শিল্পী এন্ড্রু কিশোরের ফেসবুক পেজেও তিনি ঠিক এমনি না করতে ভক্ত, শ্রোতাদের অনুরোধ করেন- “আমি আমার ভক্ত-শ্রোতাদের অনুরোধ করছি- আমরা গান ভালোবেসে বাঁচিয়ে রাখার জন্য- আমার গাওয়া গানকে স্বাভাবিক ও সাবলীল রেখে এবং বিকৃত না করে যত্ন করে রাখবেন”। প্রিয় শিল্পীর এই অনুরোধ আমরা রাখবো।
৩.
বাংলাদেশের সংগীত জগৎকে সমৃদ্ধ করতে এন্ড্রু কিশোরের অবদান অনস্বীকার্য। তিনি যেন বাংলা চলচ্চিত্র গানের এক মহাসিন্ধু, সেই সিন্ধু প্রতিনিয়ত সাঁতার কেঁটে যাচ্ছি আমরা শ্রোতারা।একদিন প্লেব্যাক সম্রাট কোটি কোটি ভক্তকে ছেড়ে হয়তো অজানা কোনো গন্তব্যে পাড়ি দিবেন, – তবে আমাদের প্রিয় এই সুরের জাদুকর তাঁর অজস্র গানের মধ্য দিয়ে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। এন্ড্রু কিশোর এমন এক ব্যক্তিসত্তা, যে সত্তা থেকে সুরের অমিয় ধারা প্রবাহিত হয়, যে সুর আকাশে – বাতাসে, নদী – সাগরে এমনকি কোটি মানুষের হৃদয়কে স্পন্দিত করে। এই উপমহাদেশের সংগীতাঙ্গনে এন্ড্রু কিশোর সন্দেহাতীতভাবে একজন বড় মাপের গুণী কণ্ঠশিল্পী। সময়ের পালাক্রমে আমরা অনেকের গানেই আনন্দ, উচ্ছ্বাস, আশা- ভরসা পেয়ে থাকি কিন্তু একজন শিল্পীর এতগুলো গানে আমাদের যে এতো মুগ্ধতা তা সত্যিই এন্ড্রু কিশোরকে অনন্য মহিমায় উদ্ভাসিত করে।তিনি শুধু সংগীত জগতকেই প্রভাবিত করেননি বরং মানুষের ব্যক্তি জীবনেও প্রভাব ফেলেছেন। এন্ড্রু কিশোর শুধু একজন শিল্পীই নন, তিনি এই উপমহাদেশ গর্ব এবং বাংলাদেশের জাতীয় সম্পদ। তাঁর আশু রোগমুক্তি কামনা করছি।
(লেখক: মো. আহসান হাবিব, তরুণ কলামিস্ট ও শিক্ষার্থী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়)