মিল্টন বিশ্বাস
বইমেলায় প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা ও সাম্প্রতিক বাংলাদেশ’ মুজিববর্ষের একটি তাৎপর্যবহ গ্রন্থ। বইটি শিক্ষাবিদ, কলামিস্ট, মিডিয়া-ব্যক্তিত্ব এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমানের অনবদ্য রচনা। এ বইতে বিভিন্ন বিষয়ে ৫০টি প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে। তার মধ্যে আমাদের ভাষা-আন্দোলন ও স্বাধীনতা-যুদ্ধের সময়ের ঐতিহাসিক দিনগুলোর ইতিহাস, স্বাধীনতা যুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবদান, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্ব এবং সাম্প্রতিক বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের যে প্রেক্ষাপট ছিল এবং সেখানে যে আদর্শ প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল তারই প্রতিফলন বর্তমান বাংলাদেশে দৃশ্যমান। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের বিভিন্ন চিত্র এ গ্রন্থে উপস্থাপিত হয়েছে। বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন এবং স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরে তাঁর স্বপ্ন কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে আর তাঁর কন্যা বর্তমান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পেরেছেন তারই বিভিন্ন প্রান্ত নিয়ে আলোচনা করেছেন লেখক। তার মধ্যে আছে একুশে ফেব্রুয়ারি ও বর্তমান বাংলাদেশ, ৭ ই মার্চের ভাষণ ও বর্তমান বাংলাদেশে তার প্রতিফলন, ২৬ শে মার্চ স্বাধীনতা দিবস এবং আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের নয়মাস পর বিজয় কতখানি অর্জিত হয়েছিল তার অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ। রাষ্ট্র-ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর যেমন তেমনি তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার ওপর মর্মান্তিক আঘাত আসে। বঙ্গবন্ধু পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার যে অপচেষ্টা চালিয়েছিল ষড়যন্ত্রকারী ও পাকিস্তানের দালালরা- ১৫ ই আগস্ট পরিবারের সকলকে হত্যার মধ্য দিয়ে এবং ২০০৪ সালের একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলায় শেখ হাসিনাকেও হত্যাচেষ্টা- এসবই আলাদা প্রেক্ষাপটে তুলে ধরেছেন লেখক।
মূলত এ গ্রন্থে লেখক বিভিন্ন বিষয়ে প্রবন্ধ সন্নিবেশিত করেছেন। তার মধ্যে অন্যতম কিছু প্রবন্ধ হলো ‘ভাষা আন্দোলনের তৃতীয় দফা এখনো পূরণ হয়নি’, ‘বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের বিশ্বজনীন আবেদন’, ‘বিজয়ের ৪৫ বছর’, ‘যে সেতু বদলে দেবে দেশ,’ ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ :বাঙালি জাতির মুখবন্ধ,’ ‘১৫ ই আগস্ট এর তিনটি হত্যাচেষ্টা : বঙ্গবন্ধু, বাঙালি ও বাংলাদেশ’, ‘১৬ কোটি মানুষের দেশে শহর মাত্র একটি’, ‘বাঙালিত্বই রুখবে জঙ্গিবাদ’, ‘আওয়ামী লীগের বিরোধিতা নাকি বাংলাদেশের বিরোধিতা’, ‘১৫ ই আগস্টের ধারাবাহিকতায় জেলহত্যা ও গ্রেনেড হামলা’, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবদান,’ ‘বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদযাপন’ প্রভৃতি।
এ সংকলনের অধিকাংশ প্রবন্ধই বঙ্গবন্ধু, বাঙালি, বাংলাদেশ ও শেখ হাসিনাকে ঘিরে। বাঙালির জন্য বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, স্থপতি, নির্মাতা সবই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে শুধু হত্যা করা হয়নি ঐদিন ওরা তিনটি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে- বঙ্গবন্ধু, বাঙালি ও বাংলাদেশকে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরবর্তীতে সামরিক শাসকদের পাকিস্তানের রাজনীতি, সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, জননেত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, তাঁর নিরন্তর সংগ্রাম, বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, জঙ্গিবাদ মোকাবেলা, বাংলাদেশের উন্নয়ন ও ডিজিটাল ধারায় পথ চলা, উন্নয়নের মহাসড়কে দেশকে তুলে আনা ইত্যাদি বহু বিচিত্র বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা ও সাম্প্রতিক বাংলাদেশ’ গ্রন্থে। মুজিববর্ষ উপলক্ষেই এ গ্রন্থখানি রচিত হয়েছে বলে ড. মীজানুর রহমান অভিমত দিয়েছেন। স্মরণীয়, বিভিন্ন ঐতিহাসিক উপকরণ নিয়ে লেখকের প্রবন্ধগুলো লেখা হয়েছে।
‘ভাষা আন্দোলনের তৃতীয় দফা এখনো পূরণ হয়নি’ প্রবন্ধে লেখক উল্লেখ করেছেন ভাষা আন্দোলনে মাত্র তিনটি দাবি ছিল। ১. রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। ২. রাজবন্দিদের মুক্তি চাই। ৩. সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু চাই। কিন্তু লেখক দুঃখ প্রকাশ করেছেন এই বলে যে, ভাষা আন্দোলনের তৃতীয় দফা এখনো পূরণ হয়নি এবং সব জায়গায় বাংলা ভাষা প্রচলন হচ্ছে না।ভাষা আন্দোলনের ব্যানার প্লেকার্ডে মূলত ওই তিনটি স্লোগানই ছিল। তিন দাবির মধ্যে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের ১৯৭২ সালের সংবিধানে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। দ্বিতীয় দাবি রাজবন্দিদের মুক্তির বিষয়টি আগেই ফয়সালা হয়েছে। তাদেরকে আমরা ভাষা সৈনিক হিসেবে সম্মান করেছি। ভাষা আন্দোলনের দাবির মধ্যে রয়েছে কিন্তু সর্বস্তরে বাংলা ভাষার বাস্তবায়ন হয়নি। আমাদের প্রধান প্রধান ক্ষেত্রে ভাষার মাধ্যম বাংলা চালু করার কথা ছিল তা হয়নি। ভাষা নিয়ে আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে অনেকের যে অভিপ্রায় ছিল আমরা তার ততটা পূরণ করতে পারিনি। আইন-আদালত বিশেষ করে উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষার প্রয়োগ হচ্ছে না। অবশ্য দুই একজন আইনজীবী বাংলায় রায় দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। উচ্চ শিক্ষায় বাংলার ব্যবহার একেবারেই নেই। সেখানে অধিকাংশ পাঠ্যপুস্তকেও বাংলা অক্ষর নেই। এর মূল কারণ পাঠ্যপুস্তকের বড় ধরনের সংকট। আজ বাংলা অনেক সমৃদ্ধ ভাষা, এর শব্দ ভাণ্ডার অফুরন্ত। শিক্ষিত সমাজ ও শিক্ষকদের গণমাধ্যমের জন্য একটি পরিশীলিত বাংলা ভাষা দরকার। শিক্ষকরা যদি নিজেই ভালো বাংলা বলতে না পারেন তাহলে শিক্ষার্থীদের শেখার কোনো সুযোগ নেই। বর্তমানে আমাদের গ্রাম এবং শহরের মাধ্যমিক এবং প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলা পড়ানোর মতো ভালো কোনো শিক্ষকও নেই।
‘কালোত্তীর্ণ ৭ মার্চের ভাষণ : আজকের প্রাসঙ্গিকতা’ প্রবন্ধে লেখক ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি উল্লেখ করেন, বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ৭ মার্চের ভাষণ। বঙ্গবন্ধু সেদিনই বাংলাদেশের মানুষকে এক হতে বলেছিলেন এবং ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছিলেন। ৭ মার্চের ভাষণের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে উইনস্টন চার্চিলের ‘উই শ্যাল ফাইট অন দি বিচেস’ ভাষণের কথা উল্লেখ করে তিনি দেখাতে চেয়েছেন ১৯৪০ সালের চার্চিলের ভাষণের সাথে বঙ্গবন্ধুর ১৯৭১ সালের ভাষণের অনেকটা মিল আছে। তিনি বলেন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সেদিন বাংলার মানুষকে আলোড়িত করেছিল। বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন রাজনৈতিকের জীবনী পড়তেন এবং তাঁর প্রিয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন দার্শনিক রাসেল। রাসেলের রাজনৈতিক দর্শনও তাঁর প্রিয় ছিল। ভাষণে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা শব্দটি উচ্চারিত করলেও মুক্তি শব্দটি ব্যবহার করেছেন বহুবার। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে, যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হয়, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ- এমনি বিভিন্নভাবে বাংলার মানুষকে মুক্ত করার আকাঙ্ক্ষা আলোচনা করেছেন প্রাবন্ধিক।
‘যে সেতু বদলে দেবে দেশ’ প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক বাংলাদেশের উন্নয়নের বিভিন্ন চিত্র তুলে ধরেছেন এবং লিখেছেন এই উন্নয়নের সারথি একমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি তাঁর পিতা বাংলাদেশের স্থপতি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেখানো স্বপ্নের সোনার বাংলা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।নানা সেক্টরের সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরেছেন। ‘যে সেতু বদলে দেবে দেশ’ বলতে তিনি পদ্মা সেতুকে বুঝিয়েছেন। পদ্মা সেতু নির্মাণের সময় বিভিন্ন মহল থেকে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র আসে কিন্তু প্রধানমন্ত্রী জানতেন এ সেতু বাংলাদেশকে বদলে দিবে। তাই তিনি বিভিন্ন দেশি-বিদেশি চক্রান্ত গ্রাহ্য না করে নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ করছেন এটি। এটি নির্মিত হলে ঢাকা শহরের সাথে দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার অনেক উন্নতি হবে এবং দক্ষিণাঞ্চল থেকে ঢাকা শহরে সহজে আসা যাবে ও ঢাকা থেকে কম সময় দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় মানুষ যোগাযোগ করতে পারবে এবং মালামাল পরিবহন করতে সক্ষম হবে। এতে দেশের উন্নয়নের চিত্র বদলে যাবে, মানুষের জীবনযাত্রা পাল্টে যাবে। শুধু পদ্মা সেতু নয়, এছাড়াও শেখ হাসিনা দেশের উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প প্রণয়ন করেছেন এবং বাস্তবায়ন হচ্ছে।
‘১৫ আগস্টের তিনটি হত্যা চেষ্টা : বঙ্গবন্ধু, বাঙালি ও বাংলাদেশ’ প্রবন্ধে ড. মীজানুর রহমান উল্লেখ করেছেন যে, সেদিন শুধু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়নি, একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছে এবং সেই সাথে বাংলাদেশের স্বপ্নকেও। বাংলাদেশ হতে পারত অনেক উন্নত এবং সমৃদ্ধশালী একটি দেশ। লেখক বঙ্গবন্ধু বলতে বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ বলতে বঙ্গবন্ধুকেই বোঝাচ্ছেন এ প্রবন্ধে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশের বিরোধিতা করে এসেছে তারি চিত্র ১৫ আগস্ট-এর হত্যাকাণ্ড। লেখক উল্লেখ করেন, বাঙালি জাতীয়তাবাদ হচ্ছে সেই সত্তা যাকে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সোহরাওয়ার্দীর মতো মহান ব্যক্তিবর্গ নিজের মতো করে আকার দিয়েছেন। আর এক কঠিন সন্ধিক্ষণে বঙ্গবন্ধুকে এই দায়িত্ব নিয়ে কাজটি শেষ করতে হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ছাড়া বাংলার ইতিহাস হয়তো দীর্ঘকালের জন্য অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকতো। পঁচাত্তরের ঘাতকদের প্রকৃত লক্ষ্য ছিল বাঙালি ও বাংলাদেশকে অভিভাবকহীন করা। যেসব রাজনৈতিক নেতা বাহবা দিয়ে বলেন যে, বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্য দিয়ে বহুদলীয় গণতন্ত্র কায়েম হয়েছে, তাদেরকে বাঙালির ইতিহাস ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। বঙ্গবন্ধুর চেতনা কখনো ম্লান হবে না। তিনি যে চেতনা বাঙালির হৃদয়ে স্থাপন করেছেন তা কখনো ম্লান হবার নয়। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা আর কোটি কোটি মুজিব সেনা ধরে রাখবে বঙ্গবন্ধুর চেতনা। ব্যক্তির মৃত্যু হয় কিন্তু চেতনার মৃত্যু হয় না। তাই বঙ্গবন্ধুর তিরোধানই হয়েছে, তাঁর মৃত্যু আসলে মৃত্যু নয় বরং তাঁকে হত্যা করার এক অপচেষ্টা মাত্র। বঙ্গবন্ধু ফিনিক্স পাখি, যিনি বারবার আগুনের ভেতর থেকে জন্ম নেন। ভস্ম হয়ে গেলেও মরেন না।
মূলত ‘বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা ও সাম্প্রতিক বাংলাদেশ’ গ্রন্থে অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান স্বতন্ত্র দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁর ভাবনাসমূহ পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছেন। সংকলিত প্রবন্ধসমূহ পাঠ করে বর্তমান প্রজন্ম ইতিহাসমনস্ক হয়ে উঠবে, রাজনীতিতে তারা সত্য উচ্চারণে সাহস পাবে এবং ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যুক্তিবাদিতার আদর্শ জয়ী হবে। গ্রন্থটির বহুল প্রচার কাম্য।
(বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা ও সাম্প্রতিক বাংলাদেশ, মেরিট ফেয়ার প্রকাশন, ২০২০, মূল্য : ৪০০ টাকা)