২৯শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার, সন্ধ্যা ৭:০৪
নোটিশ :
Wellcome to our website...

ফকির আলমগীরের প্রয়াণে বাংলা ছেয়েছে বিষণ্ণ প্রচ্ছদে

রিপোর্টার
শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:০৪ অপরাহ্ন

মিল্টন বিশ্বাস

জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী ফকির আলমগীর(১৯৫০-২০২১) মহাপ্রয়াণের মধ্য দিয়ে বাস্তব জগৎ থেকে বিলীন হলেন।তাঁর তিরোধান অপ্রত্যাশিত। তিনি ছিলেন বাঙালির অন্তরের জাগ্রত হাসি, তিনি ছিলেন কঠিন সময়ে টিকে থাকার প্রেরণা। যতদিন তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে, বইমেলা কিংবা বাংলা একাডেমির আঙিনায় সবসময়ই তাঁর হাসিমুখের চাহনি দেখেছি।জগন্নাথ কলেজে পড়েছিলেন বলে আপন ভাবতেন জগন্নাথের কাউকে দেখলে। তিনি ছিলেন আপাতমস্তক প্রগতিশীল চেতনার ধারক। গণসংগীতের যে ধারাটি ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠীর মাধ্যমে সারাদেশের মানুষকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সচেতন করে তুলেছিল তার প্রতিষ্ঠাতা ও নেতৃত্বে ছিলেন ফকির আলমগীর। তিনি সাধারণ মানুষের কাছের ছিলেন। কারণ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জীবনকে দেখার দৃষ্টি ছিল তাঁর সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে নিবেদিত।তিনি লেখক ছিলেন-তাই শিল্প-সাহিত্যের গুণগ্রাহী হিসেবে তাঁর নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা সকলের জানা ছিল। সকল বিবাদ-বিদ্বেষের উপরে থেকে বন্ধুত্বের আলিঙ্গনে নিজেকে উজাড় করে দিতে পেরেছিলেন বলেই মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছিলেন।একুশে পদকপ্রাপ্ত(১৯৯৯) এই গুণীর প্রস্থানে এজন্য বাংলার আকাশ আজ বিষণ্নতায় মলিন। তিনি ২০১৩ সালে ফেলোশিপ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার থেকে ২০১৫ সালে সঙ্গীতে মহাসম্মান পদক, ২০১৮ সালে ঢালিউড অ্যাওয়ার্ড পেলেও ‘‘স্বাধীনতা পুরস্কার’’ না পাওয়ার আক্ষেপ ছিল তাঁর মনে।২০১৯ সালে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন-‘আমি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একজন শব্দ সৈনিক। গত ৫০ বছরে গণসংগীতকে আমি গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে দিয়েছি। বন্যার মতো জাতীয় দুর্যোগ, মহামারি, রোহিঙ্গা ইস্যুসহ সমসাময়িক সামাজিক দায়বদ্ধতা ছাড়াও আমি শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে গান গেয়েছি। লেলিন থেকে লালন, মার্ক্স থেকে মাইজভাণ্ডারী— ৫০ বছর ধরে গানের এই যে তাল ধরে রেখেছি তার জন্য আমি স্বাধীনতা পুরস্কার পাওয়ার দাবি রাখতে পারি।’

২০২০ সালে শুরু হওয়ার পর এ যাবৎ অবধি করোনা মহামারি আমাদের কাছের অনেককে কেড়ে নিয়েছে। সেই সারণিতে ফকির আলমগীরও যুক্ত হলেন।২৩ জুলাই (২০২১)৭১ বছর বয়সে মৃত্যুকে অসহায়ভাবে বরণ করেন তিনি। ১৪ জুলাই এই সংগীত শিল্পীর করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে। শ্বাসকষ্ট বাড়তে থাকলে পরদিন তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ফুসফুস সংক্রমণের পাশাপাশি রক্তে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। ২৩ জুলাই রাত সাড়ে ৯টার দিকে হার্ট অ্যাটাকে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ফকির আলমগীর ১৯৫০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুরের ভাঙ্গা থানার কালামৃধা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মোঃ হাচেন উদ্দিন ফকির, মা বেগম হাবিবুন্নেছা। তিনি কালামৃধা গোবিন্দ হাই স্কুল থেকে ১৯৬৬ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন।জগন্নাথ কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় এমএ পাস করেন। ১৯৬৬ সালে ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের সদস্য হিসেবে ছাত্র রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠী ও গণশিল্পী গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে ষাটের দশকে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সংগীত জগতে প্রবেশ করেন। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে তিনি একজন শব্দ সৈনিক হিসেবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দেন।

এ পর্যন্ত এক হাজারের বেশি গান করেছেন এই গুণী শিল্পী এবং ৩০টি অ্যালবাম করেছেন। আশির দশকে দেবু চৌধুরীর প্রযোজনায় বৈশাখী প্রোডাকশন থেকে ‘আউল বাউল ফকির’ শিরোনামে তাঁর প্রথম অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। এরপর ডন মিউজিক থেকে সখিনার সিরিজ প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে তিনটি সখিনা ও চারটি পার্বতীপুর স্টেশনে। কনকর্ড থেকে প্রকাশিত হয় শবমেহের, উরিরচরের সখিনা, মধুমিতা মুভিজ থেকে প্রকাশিত হয় মুক্তি, টোকাই, সরগম থেকে সখিনার বিলাপ, শিখা অনির্বাণ অ্যালবাম। সেখানে জন হেনরি, ম্যান্ডেলার মতো গানগুলো আছে।কিছু গান আমাদের কাছে যেমন তেমনি তাঁর কাছেও প্রিয় ছিল। যেমন-মায়ের একধার দুধের ধার, ইস্কুল খোলেছেন, মন আমার দেহ ঘড়ি, ও সখিনা, মোর সখিনার কপালের টিপ, দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, কালো কালো মানুষের দেশে, বনমালি তুমি। এসব গান মানুষের মুখে মুখে শুনতে পাওয়া যায়।অবশ্য ‘ও সখিনা গেছোস কিনা ভুইলা আমারে’, ‘নাম তার ছিল জন হেনরি’, ‘মায়ের একধার দুধের দাম’ প্রভৃতি বহুল পরিচিত গান এবং মুক্তিযুদ্ধ ও গণসংগীত নিয়ে তাঁর লিখিত বই পাঠকমহলে প্রশংসিত হয়েছে।মৃত্যুর আগেও অবসরে তিনি লিখে গেছেন।শেষপর্যন্ত তাঁর ১৩টি বই প্রকাশিত হয়েছে।‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজয়ের গান’ এবং ‘গণ সংগীতের অতীত ও বর্তমান’ ছাড়াও ২০১৩ সালে প্রকাশিত- অমর কথা, যারা আছে হৃদয় পটে এবং স্মৃতি আলাপনে মুক্তিযুদ্ধ তাঁর রচিত অন্যতম গ্রন্থ।

ফকির আলমগীর বাল্যকাল থেকেই সংগীতের প্রতি আকৃষ্ট হন।হিন্দু অধ্যুষিত ফরিদপুরের ভাঙ্গাতে ছিল একটি সাংস্কৃতিক পরিবেশ।শৈশবে তিনি বন্ধুদের সঙ্গে গলা ছেড়ে কীর্তন ও বাউল গান গাইতেন। বিভিন্ন গানের আসরে উপস্থিত হতেন। এক্ষেত্রে তাঁর পিতারও উৎসাহ ছিল। তিনি তাঁকে গানের আসরে নিয়ে যেতেন।সেখান থেকেই গানের প্রতি তাঁর ভালোলাগা তৈরি হয়। এরপর বাড়িতে রেডিও শোনা এবং  রেডিওতে গান শেখার অনুষ্ঠান মনোযোগ দিয়ে শুনে সুর মিলিয়ে গান করা-আর এভাবেই ফকির আলমগীরকে সংগীত জগতে টেনে আনে।আগেই বলেছি তিনি ছিলেন প্রধানত কণ্ঠশিল্পী। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দেশের জন্য কাজ করার পর তাঁর দায়বদ্ধতা আরো বেড়ে যায়।একদিকে দেশপ্রেম অন্যদিকে মানবপ্রেম তাঁকে সারাজীবন গণসংগীতের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে উদ্দীপিত করে।মানুষের প্রতি মানুষ হিসেবে তাঁর দায়বদ্ধতা থেকে আজীবন মানুষের জন্য গান গেয়েছেন।তিনি ছিলেন গণসংগীতের নন্দিত ব্যক্তিত্ব।তাঁর মতে, ‘সংগীতের সঙ্গে যখন ‘গণ’ শব্দটি যুক্ত হয়ে এক ভিন্নধর্মী সংগীত ভাষার জন্ম দেয় তখন তাকে আমরা গণসংগীত বলি। গণসংগীত মুক্তির গান, শোষণ মুক্তির গান এবং মানবমুক্তির গান। সংগীত আমাদের বিশ্বস্ত সহচর। ‘৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ‘৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট, ‘৬২, ‘৬৯-সহ বাঙালির অনেক আন্দোলন সংগ্রামের সাথী এই গণসংগীত।’

মানুষের জন্য গান নিয়ে জীবন কাটানো ফকির আলমগীর বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন দেশে নিজের গাওয়া গান পরিবেশন করেছেন।বিশ্বের ৩০টির বেশি দেশে তিনি সংগীত পরিবেশন করেছিলেন।বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু ভাষায় যেমন গান করেছেন, তেমনি চায়নিজ, কোরিয়ান, জাপানিজ ভাষাসহ বিশ্বের যখন যে দেশে গেছেন, সেই দেশের ভাষায় গান তুলে পরিবেশন করেছেন। ১৯৭৭ সালে প্রথম কালচারাল ডেলিগেট হিসেবে আফগানিস্তান সফর করেন। এরপর বিভিন্ন দেশে গেছেন। অনেক জায়গায় সুযোগ পেয়েছেন প্রখ্যাত ওস্তাদদের সঙ্গে গান করার। তবে তিনি জনগণের শিল্পী ছিলেন বলেই দর্শক- শ্রোতাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ পছন্দ করতেন।এজন্য সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন মঞ্চের অনুষ্ঠানে।  সেখানে প্রতিক্রিয়াও পাওয়া যেতো সঙ্গে সঙ্গে।

১৯৭১ সালে সরাসরি তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তাঁর বাড়ি ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলার শিবচর থেকে প্রথমে ১ জুলাই ভারতে ট্রেনিংয়ের জন্য যান। এরপর যুদ্ধে অংশ নেন। যুদ্ধের ময়দানে যখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনতেন, মনে হতো তাঁকে সেখানে গিয়েই গানের মাধ্যমে যুদ্ধ করতে হবে। আর সেটাই তিনি করেছিলেন। যশোর রোড ধরে গিয়েছিলেন। মৌসুমী ভৌমিকের যশোর রোডের গানটি তিনি কোনো দিন ভুলতে পারেননি।বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের উত্তাল ভাষণ শুনে কম বয়সের অনেকেও যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। রাজপথে দুরন্ত মিছিলে সবাই ছুটে এসেছিল রেসকোর্স ময়দানে। বঙ্গবন্ধুর বজ্র কণ্ঠ ভেসে আসে তাঁর কানে। তিনি যেন কবিতার ঢেউ ঠেলে দিয়েছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’। বঙ্গবন্ধু সেই ভাষণের মধ্য দিয়ে দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে যুদ্ধে গিয়েছিলেন তিনি।স্বাধীন বাংলা বেতারের গান সরাসরি সম্প্রচার হতো। একটা মাইক্রোফোন দিয়ে তবলা, দোতারা, হারমোনিয়ামে ও মন্দিরার সাউন্ড যেত। সেই সময় অনেক কষ্ট করে তিনি গান করেছেন। সেটাকে স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রস্তুতির গান, স্বাধীন বাংলা বেতারের গান ও মুক্তির গান এই তিন পর্বে ভাগ করা যায়।এই শিল্পীর স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নেওয়ার স্বপ্ন ছিল শোষণহীন ও দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার।কিন্তু এটা বাস্তবায়িত হয়নি বলে তাঁর আক্ষেপ ছিল।

ফকির আলমগীর চেয়েছিলেন গণসংগীতকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে, ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠীর পরিধি বাড়াতে। ভবিষ্যতে গণসংগীতের শিল্পী পাওয়ার প্রত্যাশা থেকে ‘গণসংগীত একাডেমি’ করার ইচ্ছে ছিল তাঁর।কারণ গণসংগীতের শিল্পী হিসেবেই নিজেকে পরিচয় দিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন।তাঁর আকস্মিক প্রয়াণ কাজগুলো অসমাপ্ত রেখে গেছে।আসলে শিল্প-সাহিত্য কেবল আনন্দ-বিনোদনের জন্য নয় বরং সমাজের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সংগীত ও লেখনি কাজ করতে পারে। তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন ফকির আলমগীর।

(লেখক : ড. মিল্টন বিশ্বাস,  ইউজিসি পোস্ট ডক ফেলো এবং বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, email-drmiltonbiswas1971@gmail.com)


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ
এক ক্লিকে বিভাগের খবর