২৯শে নভেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, বুধবার, সকাল ৮:৩১
নোটিশ :
Wellcome to our website...

নক্ষত্রের নাম : স্যামসন এইচ চৌধুরী

রিপোর্টার
বুধবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৩, ০৮:৩১ পূর্বাহ্ন

রিপন ধীমান বিশ্বাস

পাবনা অঞ্চলে মানব কল্যানে যারা কাজ করে গেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন স্যামসন এইচ চৌধুরী। তিনি তার কাজের মাধ্যমে এক কিংবদন্তী ইতিহাস তৈরী করেছেন। তিনি ১৯২৫ খ্রীষ্টাব্দে ২৫ শে সেপ্টম্বর গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দি গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। ১৯৩০ খ্রীষ্টাব্দে চাঁদপুরের একটি মিশন স্কুলে তিনি তার পড়াশুনা শুরু করেন। তার বাবা ছিলেন ডা: ইয়াকুব হোসেন চৌধুরী ও মায়ের নাম লতিকা চৌধুরী। তিনি ছিলেন তার বাবা মায়ের প্রথম সন্তান। ইয়াকুব হোসেন চৌধুরী তার ছেলের নাম দিয়েছিলেন শিমশোন। হয়তো তিনি ভেবেছিলেন তার সন্তান বাইবেলের সেই শিমশোনের মতই শক্তিশালি হবে। বাস্তবিক ঞ্জানে ও বুদ্ধিতে তিনি সেই শক্তিরই অধিকারী হয়েছিলেন। তার বাবার ছিল বদলির চাকরি। চাঁদপুরের পর ১৯৩২ খ্রীষ্টাব্দে ইয়াকুব হোসেন চৌধুরী পাবনার আতাইকুলাতে আসেন। তারপর স্যামসন এইচ চৌধুরী এখানের গ্রামের স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৩৩ খ্রীষ্টাব্দে তার বাবা তাকে ময়মনসিংহে পাঠান এবং সেখানে তিনি ভিক্টোরিয়া মিশন স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন। এরপর ১৯৩৫ খ্রীষ্টাব্দে তার বাবা পশ্চিম বাংলায় পাঠান এবং সেখানে তিনি বিঞ্চুপুরের বোডিং শিক্ষা সংঘ হাই স্কুলে ভর্তি হন।

দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের সময় ১৯৪২ খ্রীষ্টাব্দে তিনি পাবনায় ফিরে আসেন। ১৯৪৩ খ্রীষ্টাব্দে তিনি আতাইকুলা স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করেন। জানা যায় তিনি স্কটিশ চার্চ কলেজ কলকাতায় পড়াশুনা করেন। এরপর তিনি হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি স্কুল থেকে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে ডিপ্লোমা ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি মা বাবার অজান্তে ভারতীয় নেভিতে যোগদান করেন। ১৯৪৬ খ্রীষ্টাব্দে ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে নৌ বিদ্রোহে অংশগ্রহন করেন এবং অবশেষে গ্রেপ্তার হন। ৫ দিন জেলে থাকার পর তাকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে এক মাসের জন্য পাঠানো হয়। এরপর তাকে মুক্তি দেয়া হয়। মুক্তি দেবার সময় তাকে ক্লিন সার্টিফিকেট দেয়া হয় যেন যেকোন সরকারী প্রশাসন বিভাগে চাকরী পেতে তার কোন অসুবিধা না হয়।

১৯৪৭ খ্রীষ্টাব্দে তিনি সরকারী চাকুরীজীবি হিসাবে ডাকবিভাগে যোগ দেন। এই সময়ে তার জীবনে আসে ১৫ বয়সী কিশোরী অনিতা বিশ্বাস। ১৯৪৭ খ্রীষ্টাব্দের ৬ ই আগষ্ট স্যামসন এইচ চৌধুরী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৫২ খ্রীষ্টাব্দে তিনি ডাক বিভাগে চাকুরী ছেড়ে আতাইকুলাতে ফিরে আসেন এবং বাবার ঔষধের দোকান হোসেন ফার্মেসীতে কাজ শুরু করেন। ১৯৫৬ খ্রীষ্টাব্দে তিনি তার বাবার কাছ থেকে টাকা ধার করে একটি ছোট ফার্মাসিউটিক্যাল কম্পানি চালু করেন। এবং এর নাম দেন ‘‘এসন’’(E sons’’। পরবর্তিতে তিনি নামটি পরিবর্তন করে “ইয়াকুব এন্ড সনস” রাখেন।

১৯৫৮ খ্রীষ্টাব্দে তিনি ও তার তিন জন বন্ধু মিলে ‘‘স্কয়ার” নামক ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি চালু করেন। তার এই তিন বন্ধুর নাম ছিল ডা: কাজী হারুন আর রশিদ, ডা: পি কে সাহা ও রাধা বিনোদ রায়। তাদের প্রথম মুলধন ছিল ১৭,০০০ রূপি। ১২ জন শ্রমিক, কাঁচাপাকা ভবনে ফ্যাক্টরি, কয়েকটি মেশিন ও সল্পপুজি অথচ আকাশসম স্বপ্ন ও উদ্দম নিয়ে স্কয়ারের যাত্রা শুরু। তিনি দেখেন ম্যালেরিয়া রোগীদের ভারতে উৎপাদিত কুইনাইন চড়া দামে কিনতে হয়। অথচ কুইনাইন তৈরির কাঁচামাল দর্শনার কেরু এন্ড কোম্পানীর চিনিকলে পাওয়া যায়। ১৯৬২ খ্রীষ্টাব্দে তারা ঢাকার হাটখোলাতে একটি শাখা উদ্বোধন করেন। পরবর্তিতে স্কয়ার প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানিতে পরিণত হয় এবং এই সময় তাদের মূলধন ছিল ৪০,০০০ রূপি। গুনগত মানের দিক দিয়ে স্কয়ার এর সকল প্রোডাক্ট ছিল অতুলনীয়। সেজন্য আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশের সমস্ত কোম্পানিগুলির মধ্যে শীর্ষস্থান লাভ করে এবং আজ পর্যন্ত এক নম্বর অবস্থানেই আছে। স্কয়ারই প্রথম দেশীয় কোম্পনি যা বিদেশে ঔষধ রফতানির জন্য অনুমদিত হয়।

১৯৮৮ সালে আলাদা আরো একটি বিভাগের যাত্রা শুরু হয় যার নাম স্কয়ার ট্রয়লেট্রিজ। স্কয়ার গ্রæপ এখন ফার্মাসিউটিক্যালস, টেস্ক্রটাইল, রেডিমেট গার্মেন্স, ট্রয়লেট্রিজ, ইনফরমেটিকস, খাদ্য শিল্প, মিডিয়া (মাছরাঙা টেলিভিশন), স্কয়ার হাসপাতাল ইত্যাদি বিভিন্ন দিকে তাদের পদচারনা সফলভাবে করে যাচ্ছে।

স্যামসন এইচ চৌধুরী ব্যক্তিগত জীবনে ভীষন বন্ধুসুলভ ছিলেন। তিনি স্কয়ারে একটি দক্ষ-কর্মীবাহিনি ও বিশ^মানের পেশাদার ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। সব কর্মীদের সাথে তার ছিল পিতৃসুলভ আচরন। তিনি ও তার স্ত্রী অনিতা চৌধুরী তাদের সমস্ত কর্মীকে নিজের সন্তান বলে পরিচয় দিতেন। ব্যক্তিগত জীবনে স্যামসন এইচ চৌধুরীর তিনজন ছেলে ও একজন মেয়ে আছেন। তারা হলেন : স্যামুয়েল স্বপন চৌধুরী, তপন চৌধুরী, অঞ্জন চৌধুরী ও মেয়ে রত্না চৌধুরী।

স্যামসন এইচ চৌধুরী কোনদিন মানের সাথে আপোষ করেননি। অত্যন্ত স্বচ্ছ, সততা ও দক্ষতার সাথে গড়ে তুলেছেন বিশাল সামাজ্য। তিনি তার জীবনে অনেক পুরস্কার ও স্বীকৃতি পেয়েছেন। ২০১০ সালে অর্থনীতিতে বিশেষ আবদান রাখার জন্য সরকার থেকে বিশেষ সম্মাননা লাভ করেন। ২০০০ সালে দ্যা ডেইলি স্টার ও ডি এইচ এল প্রদত্ত বিজনেস ম্যান অব দ্যা ইয়ার, ১৯৯৮ সালে আমেরিকান চেম্বার অব কমার্সের বিজনেস এক্সিকিউটিভ অব দ্যা ইয়ার এবং ২০১৩ সালে একুশে পদক লাভ করেন। স্কয়ার গ্রæপ ২০০৯-১০ অর্থবৎসরে জাতীয় রাজস্ব বোড কর্তৃক সেরা করদাতা নির্বাচিত হয়েছিল। স্যামসন এইচ চৌধুরী ছিলেন স্কয়ার গ্রæপের চেয়ারম্যান, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের চেয়ারম্যান, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারম্যান, সভাপতি মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স এবং আরো অনেক প্রতিষ্ঠানের সম্মানিত পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।

তিনি যে শুধু তার কর্ম জীবনে সফলভাবে অবদান রেখেছেন তা নয়। ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনেও তার অবদান ছিল অপরিসীম। তিনি সক্রিয়ভাবে চার্চের কাজে যুক্ত ছিলেন। তিনি ৪২ বছর ধরে বিবিসিএফ এর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি ১৩ বছর বিবিসিএফ এর সম্পাদক (১৯৫৬ – ১৯৬৯) এবং সভাপতির (১৯৮৩ – ১৯৮৫) ও (১৯৯০ – ১৯৯৩) দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সভাপতি থাকা অবস্থায় সিন্ধান্ত হয়েছিল ১৭ টি মন্ডলী থেকে ১০ বছরে মন্ডলীর সংখ্যা ২০০ টি করতে হবে। তার নেতৃত্বে এবং ঈম্বরের আশীর্বাদে তাদের এই অভিযান সফল হয়েছিল। এছাড়া তিনি ব্যাপ্টিষ্ট ওয়াল্ড এলায়েন্সের সহ সভাপতি (১৯৮৫ – ১৯৯০) ছিলেন। তিনি ও তার পরিবার বিভিন্ন ভাবে বহু সামাজিক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত। আমাদের পাবনা বয়েজ হোস্টেল ও আতাইকুলা বয়েজ হোস্টেলের আর্থিক অনুদান এই চৌধুরী পরিবার থেকে আসে। এরকম আরো হাজার হাজার উদাহরন রয়েছে যা উল্লেখ করলে লেখা শেষ করা কঠিন। তিনি এত বড় মাপের মানুষ হলেও তার জীবনে প্রার্থনা ও বাইবেল পড়াকে সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দিয়েছেন। ১৯৮৩ সালের সম্মিলনীর ৬৩ তম সাধারন সভায় মি: স্যামসন এইচ চৌধুরী বলেন “প্রার্থনাই হলো ভক্তদের জীবনে সবচাইতে বড় শক্তি । প্রার্থনা শুধু ব্যক্তিগত জীবনেই শক্তি যোগায় না বরং প্রার্থনা সমগ্র মন্ডলীকে উদ্দীপ্ত করতে সক্ষম। প্রার্থনা শুধু চাওয়া না, প্রার্থনা প্রভু যীশুর চরনে নতজানু হয়ে ধন্যবাদ এবং কৃতঞ্জতা স্বীকারই ভক্তদের জীবনে প্রভুর আশীর্বাদ বয়ে আনে”। অতএব আমরা বুঝতে পারি তিনি জীবনে যীশুর উপর কতটা নির্ভর করতেন এবং প্রতিনিয়ত প্রার্থনাশীল জীবন কাটাতেন। কর্মক্ষেত্রে ও ব্যক্তিগত ভাবে এই মহান ব্যক্তির সানিদ্ধ লাভ করার সুযোগ আমার হয়েছে।

তার বাড়িতে তার নিয়ম ছিল “No bible, No breakfast” সুতরাং আমরা বুঝতে পারি তিনি তার জীবনে বাইবেল ও প্রার্থনাকে কতটা গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি ২০১২ খ্রীষ্টাব্দের ৫ ই জানুয়ারী ৮৭ বৎসর বয়সে সিংগাপুরের একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরন করেন। পাবনার কাশিপুরস্থ খামার বাড়ি এষ্ট্রাসে স্যামসন এইচ চৌধুরীকে সমাহিত করা হয়। আমরা এই মহান ব্যক্তির জীবনের জন্য পিতা ঈশ^রকে ধন্যবাদ জানাই।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ
এক ক্লিকে বিভাগের খবর