ড. আলো ডি’রোজারিও
১। আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ লিখেছেন, বাঙালি জাতি সভ্যতা, সংস্কৃতি, শিক্ষা, সাহিত্য, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে ভারতীয় উপমহাদেশে সবসময়ই অগ্রগণ্য ছিল। কিন্তু বাঙালির নিজস্ব কোন রাষ্ট্র ছিল না। বঙ্গবন্ধু এই অগ্রসর জাতিকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র দিয়ে জাতির হাজার বছরের পরিক্রমায় এক অনন্য স্থান অধিকার করে নিয়েছেন। তাই আমরা তাঁকে বলি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। আমরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হতো না। তিনি জাতির পিতা কেবল এই কারণে নন যে, স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি জাতির পিতা এই কারণেও যে, এই দেশের যা কিছু- সবই তিনি জন্ম দিয়েছেন। এমনকি ’বাংলাদেশ’ নামটিও তাঁর দেয়া। মহামান্য রাষ্ট্রপতি আরো লিখেছেন, আমরা যারা ষাটের দশকে বাঙালির রাখাল রাজা শেখ মুজিবের আহবানে রাজনীতিতে দীক্ষা নিয়েছিলাম, তাদের কাছে বঙ্গবন্ধু কেবল একজন ব্যক্তি নন। বঙ্গবন্ধু মানে আমাদের কাছে একটি প্রতীক, একটি আবেগ, একটি হৃদয় নিংড়ানো আহবান, একটি নতুন দিগন্তের নাম। আমরা যারা মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি, স্বজন ও সহযোদ্ধার রক্ত ও প্রাণের বিনিময়ে দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছি; তাদের কাছে বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ।১
২। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ড. আতিউর রহমান লিখেছেন, সাধারণ মানুষের বিশেষ করে সারাদেশের গ্রাম-গঞ্জের কৃষকদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর দরদ ও ভালবাসার কথা ও সেসাথে সরলপ্রাণ খেঁটে-খাওয়া কৃষি-নির্ভর পরিবারগুলোর ভাগ্য-উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর অবদানের কথা। তিনি লিখেছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান হৃদয়মাঝে সারাজীবন তন্নতন্ন করে খুঁজে বেড়িয়েছেন স্বদেশকে। আর তাই যখনই যেখানে গিয়েছেন, মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলেছেন, সাধারণ মানুষের কথা, কৃষি ও কৃষকের কথা, শ্রমিকের কথা। তাঁর শোষণহীন সমাজ গঠনের স্বপ্নের জমিনের বড় অংশ জুড়ে ছিল বাংলাদেশের কৃষক।২ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগের বছর ১৯৭০ সালে এবং স্বাধীন হওয়ার বছর ১৯৭১ সালের শুরুর দিকে বিভিন্ন স্থানে দেয়া গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, তাঁর দল ক্ষমতায় গেলে কৃষক সমাজের স্বার্থ সংরক্ষণার্থে তাদের সকল দাবি ও অধিকার অত্যন্ত যত্ন সহকারে বিবেচনা করবেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর কথা রেখেছিলেন।
৩। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ঢাকায় ফিরেন আসেন। ঢাকায় ফিরে তিনি সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এ দেশের শাসনভার তুলে নেন নিজ কাঁধে। সরকারেরর দায়িত্ব নেবার পরপরই কৃষি ক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি এবং কৃষক যেন ঘুরে দাঁড়াতে পারে সেজন্যে তিনি বেশ কিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ছিল : কৃষকদের মাঝে ১০ কোটি টাকার তাকাভী ঋণ বণ্টন, পাঁচ কোটি টাকার সমবায় ঋণ বণ্টন, ৮৩ হাজার টন সার সংগ্রহ ও ৫০ হাজার টন সার বণ্টন, ১৬ হাজার ১২৫ টন ধানের বীজ বণ্টন, তিন হাজার মণ গমের বীজ বণ্টন, এক হাজার ৭০০ টন আলু বীজ বণ্টন, ৪৫৪ টন পাট বীজ বণ্টন, সেচের জন্য ২৯শ’ গভীর নলকূপ ও তিন হাজার অগভীর নলকূপ স্থাপন, বিএডিসিকে নামমাত্র মূল্যে পাওয়ার টিলার ও ট্রাক্টর সরবরাহ, নামমাত্র মূল্যে কৃষকদের মধ্যে হালচাষের জন্য এক লাখ বলদ ও ৫০ হাজার দুগ্ধবতী গাভী সরবরাহ, একটানা তিন মাস খাদ্যশস্যসহ ৩০ কোটি টাকার ত্রাণ বিতরণ ও উচ্চহারে ভর্তুকি প্রদান পূর্বক সব ধরনের সারের অতি নিম্নমূল্য নির্ধারণ। এছাড়াও, বঙ্গবন্ধু উদ্বৃত্ত জমি ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিতরণের লক্ষ্যে পরিবারপ্রতি জমির সিলিং ১০০ বিঘা নির্ধারণ করেন। তিনি ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা চিরতরে রহিত করে দেন ও কৃষকদের রক্ষা করেন পাকিস্তানী আমলে রুজু করা ১০ লাখ সার্টিফিকেট মামলা হতে। বঙ্গবন্ধু কৃষি গ্র্যাজুয়েটদের সরকারি চাকুরিতে যোগদান দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা থেকে প্রথম শ্রেণির মর্যাদায় উন্নীত করার উদ্যোগ নেন। এ বিষয়ে তিনি ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেন। তাঁর এই ঘোষণা বাংলাদেশে কৃষিখাতে এক যুগান্তকারী প্রভাব ফেলে কারণ তখন হতে মেধাবী তরুণরা অধিক সংখ্যায় কৃষি শিক্ষায়, কৃষি গবেষণায় ও কৃষি পেশায় যোগদান করতে থাকেন।
৪। বঙ্গবন্ধু যতটুকু সময় পেয়েছিলেন সেইটুকু সময়ে কৃষিখাতের উন্নয়নে ও কৃষক সমাজের কল্যাণে নীতিমালা প্রণয়নসহ যেসব পদক্ষেপ নিতে পেরেছিলেন সেসবের একটি বর্ণনা পাওয়া যায় ড. মো. শহীদুর রশিদ ভূঁইয়ার লেখাতে, তার লেখার শিরোনাম: বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের কৃষি।৩ আমাদের দেশের জমিতে বিজ্ঞানভিত্তিক চাষাবাদ করতে পারলে ফলন যে বৃদ্ধি পাবে বঙ্গবন্ধু তাঁর এক বক্তৃতায় এ বিষয়টিও তুলে আনেন … আপনারা জানেন, আমার দেশে এক একর জমিতে যে ফসল হয়, জাপানের এক একর জমিতে তার তিনগুণ ফসল হয়। কিন্তু আমার জমি দুনিয়ার সেরা। আমি কেন সেই জমিতে ডাবল ফসল করতে পারব না? আমি যদি দ্বিগুণ করতে পারি তাহলে আমাকে খাদ্য কিনতে হবে না; ভিক্ষা করতে হবে না। …আমি চাই বাংলাদেশের প্রত্যেক কৃষক ভাইয়ের কাছে; যারা প্রকৃত কাজ করে, যারা প্যান্ট পরা কাপড় পরা ভদ্রলোক, তাদের কাছেও চাই, জমিতে যেতে হবে। ডাবল ফসল করুন। প্রতিজ্ঞা করুন, আজ থেকে ওই শহীদদের কথা স্মরণ করে ডাবল ফসল করতে হবে। যদি ডাবল ফসল করতে পারি, আমাদের অভাবও ইনশাল্লাহ হবে না। কারও কাছে ভিক্ষুকের মতো হাত পাততে হবে না। আজ বাংলাদেশ খাদ্যে উদ্বৃত্ত দেশ, মূলে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনা ও প্রেরণা এবং কৃষকসমাজের পরিশ্রম। সেসাথে রয়েছে বর্তমান সরকারের কৃষি-বান্ধব নীতি, সহযোগিতা ও প্রণোদনা।
৫। বঙ্গবন্ধু কৃষিক্ষেত্রে গতিশীলতা আনতে উপরে বর্ণিত স্বল্পমেয়াদী কিন্তু অতি জরুরি বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার পর কৃষিক্ষেত্রে মধ্যমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মাধ্যমে তিনি মধ্যমেয়াদী লক্ষ্য অর্জন করার দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আমলেই শুরু হয় কৃষির প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে তিনি বেশ কয়েকটি কৃষি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, ইক্ষু গবেষণা প্রতিষ্ঠান, মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন, এসবই বঙ্গবন্ধু গড়ে তোলেন। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি কৃষিজদ্রব্য বিপণন, রপ্তানি ও প্রক্রিয়াজাতকরণ সম্পর্কিত নীতিমালা তৈরি করতেও তিনি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নেন। সেজন্যে, ড. আতিউর রহমান উপরে উল্লেখিত তার লেখায় লিখেছেন, বঙ্গবন্ধু অসম্ভব রকম দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতা ছিলেন বলে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, কৃষক ও কৃষির উন্নয়ন ছাড়া এ দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। ক্ষুদ্র কৃষকদের স্বার্থ রক্ষায়ও তিনি জোর দিয়েছিলেন, আর সেটা তিনি দিয়েছিলেন সমবায়ভিত্তিক চাষবাসে সুবিধা ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে। সমবায়ভিত্তিক চাষবাসের মূল লক্ষ্য ছিল জোতদার কৃষকের শোষণ থেকে ছোট বা ক্ষুদ্র কৃষকের স্বার্থ সংহত করা। আজ কৃষিতে আমাদের যে অনন্য সাফল্য, তা বঙ্গবন্ধুরই চিন্তার ধারাবাহিকতা। তাঁর চিন্তাকে তাঁরই কন্যা শেখ হাসিনা সুনিপুণভাবে বাস্তবায়ন করতে সমর্থ হয়েছেন।
৬। আমাদের দেশের কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের ভাবনা বঙ্গবন্ধু আজীবন লালন করেছেন। বঙ্গবন্ধু জানতেন, এ দেশের কৃষক ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠী, এ দেশের কৃষি ও মাটির সঙ্গে সম্পৃক্ত। ফলে, উন্নয়নের গতিধারায় এ সম্পর্ক যেন নষ্ট না হয়। গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে কৃষিই ছিল বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান খাত। তখন দেশের জনসংখ্যার সিংহভাগ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষি-নির্ভর ছিল। এই কৃষিকে এবং কৃষিকাজে নিয়োজিত আধপেটা-একপেটা কৃষকদের দেখে দেখেই বড় হয়েছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের ভয়াবহ চিত্র তিনি দেখেছেন আর ছুটে বেড়িয়েছেন গ্রাম হতে গ্রামে বুভুক্ষু মানুষদের খাদ্য সাহায্য দিতে। তখন তিনি দেখেছেন পাকিস্তানি শাসকদের বিমাতাসুলভ আচরণ, বুঝতে পেরেছেন কীভাবে কৃষির প্রতি তাদের চরম অবহেলা এ দেশকে খাদ্য ঘাটতির দেশে পরিণত করেছে। ফলে কৃষি ও কৃষক না বাঁচলে যে দেশ বাঁচবে না– এ কথা তিনি যথার্থই বুঝেছিলেন। গ্রামের দরিদ্র কৃষক আর ভুখা-নাঙ্গা মানুষদের ভাগ্যের পরিবর্তন করার জন্যই শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর যত আন্দোলন যত সংগ্রাম। বাংলাদেশের কৃষকদের দুরবস্থা দেখে তিনি সবসময় বলতেন, আমার দেশের কৃষকেরা সবচাইতে নির্যাতিত। তাই তাদের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে।
৭। বঙ্গবন্ধু অল্প বয়স থেকেই মানুষের দুঃখ-কষ্টে খুবই ব্যথিত হতেন। মানুষের মধ্যে অসমতা তিনি কোনমতেই গ্রহণ করতে পারতেন না। বঙ্গবন্ধুর পূর্বপুরুষরা একসময় বড় ভূস্বামী ছিলেন। তবে তাঁর জন্ম হয় মধ্যবিত্ত পরিবারে। মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম হওয়া সত্বেও তিনি ভালোভাবেই জানতেন মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত, দরিদ্র ও হতদরিদ্র কৃষক পরিবারের অবস্থা ও দুঃখ-বেদনা। তাঁর সেই জানা থেকেই কৃষকদের জন্যে বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ে ছিল বিশেষ দরদ ও সহমর্মিতা। তাঁর হৃদয়ের আকুতিতে ছিল, কৃষি ও কৃষকের উন্নতি, বিশেষ করে অধিক ফসল উৎপাদন, উৎপাদিত কৃষিপণ্যের সংরক্ষণ, বাজারজাতকরণ ও ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি। বাংলাদেশের কৃষির উন্নয়নে ও কৃষক সমাজের কল্যাণে বঙ্গবন্ধুর ধারণা, চিন্তাভাবনা, পরিকল্পনা, নির্দেশনা ও উদ্যোগ এখনো আজকের বাংলাদেশে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও অর্থবহ। বঙ্গবন্ধুর কৃষকদরদী নীতির ফলে কৃষিক্ষেত্রে অগ্রগতির যে ধারার সূচনা হয়েছিল, তারই ফলে আজো কৃষিক্ষেত্রে শক্তিশালী ধারা বজায় আছে। যেকোন মূল্যে এই ধারা বজায় রাখতে হবে। কারণ দিন যত যাচ্ছে ততই বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিবেশে কৃষির গুরুত্ব বাড়ছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগ প্রযুক্তিনির্ভর হলেও এ কথা আজ স্বতঃসিদ্ধভাবে সত্য, কৃষির আধুনিকায়ন ও যৌথ প্রয়াস ছাড়া এ সভ্যতা টিকবে না। শিল্প কৃষিকে প্রভাবিত করে। তার আগে এ কথা মানতে হবে যে, কৃষিই শিল্প খাতকে চালিত করে।
সূত্র:
১। মো. আবদুল হামিদ, ’চিরপ্রাসঙ্গিক বঙ্গবন্ধু’, দৈনিক সমকাল, ১৭ মার্চ ২০২০
২। ড. আতিয়ার রহমান, ’কৃষক অন্তপ্রাণ বঙ্গবন্ধু ও আজকের বাংলাদেশ’, দৈনিক সমকাল, ৪ মার্চ ২০২০
৩। ড. মো. শহীদুর রশীদ ভূঁইয়া, ’বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের কৃষি’, দৈনিক সমকাল, ৯ মার্চ ২০২০
(ড. আলো ডি’রোজারিও, সাবেক নির্বাহী পরিচালক, কারিতাস বাংলাদেশ, প্রেসিডেন্ট, কারিতাস এশিয়া)