২৬শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার, সকাল ৭:২২
নোটিশ :
Wellcome to our website...

কাঁকড়া নিয়ে যত কথা

রিপোর্টার
শুক্রবার, ২৬ জুলাই ২০২৪, ০৭:২২ পূর্বাহ্ন

মোঃ আব্দুল বাকী চৌধুরী নবাব

অ) প্রতিপাদ্য বিষয় কাঁকড়া (ইংরেজিতে এর প্রতিশব্দ হলো Crab) হলেও প্রথমে কিছু কথা না বলে পারছি না। ষাট দশকের শেষের দিকে কথা। তখন আমি সবে দশ বছরে পা দিয়েছি। থাকতাম আমার জন্মভূমি পাবনা জেলাস্থ যমুনা নদীর পশ্চিম পাশে মধুপুর গ্রামে। অবশ্য গ্রামটি ১৯৯০ সালে নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছে। যাহোক, এই ছায়া সুনিবিঢ় তরু-পল্লবে ঘেরা গ্রামটির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো পূর্বে যমুনা নদী এবং পশ্চিমে কোলচিনাখরা নামক স্রোতহীনতা একটি তটিনি। এদিকে সময়ের পরিক্রমার আমার বর্ধিষ্ণু বয়েসের সুবাদে সব কিছু ধীরে ধীরে যখন বুঝতে শুরু করেছি, সেই সময় সকালে খেয়াল করতাম নদীর তীরে সদ্য তোলা কাঁকড়া কর্তৃক শত শত গুড়ি গুড়ি মাটির উচু টিপি। তখন আমরা ছোট ছেলে-মেয়েরা যেয়ে কৌতুহল বশতঃ ক্রীড়ার ছলে গর্তে লাটি দিয়ে খোঁচা দিলে কাঁকড়া উঠে এসে পানির দিকে দৌড় দিতো। অনেক সময় ধরতে গেলে ওদের দুটি বড় বড় পায়ের চেংড়ি বা গোধ বা দাড়া দিয়ে আঁচড়ে ধরতো। যাহোক, এর মধ্যে বেশ কয়েক বছর চলে গেছে। আমি প্রাইমারী স্কুলের সর্বশেষ ক্লাশের ছাত্র। তখন কাঁকড়াকে নিয়ে খোঁচাখুঁচি খেলা কমে গেলেও একেবারে শেষ হয়নি। একদা এ ধরনের খেলায় আমরা সবাই যখন মেতে আছি। তখন একজন স্যুট-কোট পড়া লোক ওখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি আমাদের ডেকে বলেন, তোমরা যে কাঁকড়াকে নিয়ে এ রকম করছো, তোমরা কি জানো এর অনেক দাম? কেননা বাইরের দেশে চিংড়ি মাছের মতো বিদেশীরা কাঁকড়া খেতে খুব পছন্দ করে। সেই সময় ভদ্রলোকের কথাটি শুনে বেশ অবাক হয়ে যাই। অতঃপর স্কুল, কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয়ের জীবন শেষ করে যখন বড় পদে সরকারি চাকুরীতে প্রবেশ করি। তখন সেই ভদ্রলোকের কথার শতভাগ সত্যতা নিজেই প্রত্যক্ষ করি। কারণ বাস্তবে দেখতে পাই যে চিংড়ি মাছের মতো কাঁকড়াও চাষ করা হয় এবং এর হ্যাচারীও আছে। শুধু তাই নয়, এগুলো বিদেশে রফতানি করে মূল্যবান ফরেন এক্সচেঞ্জ আয় হয়। মজার ব্যাপার হলো যে, এই বিশ্বের কোন কিছু ফেলনা নয়। এক জাতি না খেলেও অন্য জাতি খেয়ে থাকে। আর চীনে সাপ, ব্যাঙ, কুকুর, বিড়াল, শেয়াল, ইত্যাদি কত কিছু যে খেয়ে থাকে, তার ইয়াত্তা নেই। এদিকে ইসলাম ধর্মে খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে হারাম, হালাল ও মাকরু বলে কিছু কথা আছে। মাকরু এমন একটি বিষয়, যা হারাম ও হালাল এর মাঝা-মাঝি এবং সুন্নতের বরখেলাপ। তবে কাঁকড়া হালাল না হারাম না মাকরু, সে ব্যাপারে বিতর্ক রয়েছে। যাহোক, এতক্ষণ ধান ভানতে শিবের গীতের কথা বললাম। এবার আসুন, আসল বিষয়টিকে নিয়ে কথাবার্তা বলি। আসলে কাঁকড়া পানির পোকা এবং মাছের বৈশিষ্ট্যর দিক দিয়ে তার ধারের কাছেও নেই। আর আশ্চর্য্যরে বিষয় হলো যে এই কাঁকড়া সামনে, পেছনে ও পাশে একই ভাবে চলতে পারে।

ছবি: কাঁকড়া


আ) বস্তুতঃ কাঁকড়া ক্রাসটাসিয়া (Crustacea) শ্রেণির ডেসাপোডা (Decapoda) বর্গের শক্ত খোলসবিশিষ্ট জলচর অমেরুদন্ডী প্রাণী। এরা সমুদ্র, নদী, হাওর, বাওড়, পুকুর, ইত্যাদি স্থানে বাস করে। এদের দেহের উপরিভাগে প্রায় গোলাকৃতির প্রশস্ত ক্যারাপেস (Carapce) এবং দেহের নিচের দিকে গোটানো ছোট আকারের উদর থাকে। বিভিন্ন প্রজাতির দৃষ্টিকোণ থেকে কাঁকড়ার আকৃতি, বর্ণ ও গঠন ভিন্ন ভিন্ন হলেও সকলেরই জবিতাত্তি¡ক ও সাধারণ অঙ্গসংস্থানিক বিষয় একই ধরনের। এ পর্যন্ত বাংলাদেশের জলভাগে ১৬ প্রজাতির কাঁকড়া শনাক্ত করা হয়েছে। আর এর মধ্যে খাদ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে মাত্র ৬টি প্রজাতির কাঁকড়া; যেমন- স্কিলা (Scylla), পারটুনাস (Partunus), ক্যারিবডিস (Charybdis), মাটুটা , ভারুনা এবং সারটরিনা । এদের অধিকাংশ প্রজাতিই অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হলেও খাজকাটা কাঁদামাটির কাঁকড়া বা ম্যানগ্রোভ কাঁকড়া বাণিজ্যিক দিক থেকে সবচেয়ে বেশি লাভজনক, যা পাওয়া যায় বঙ্গোপসাগরসহ ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জলভাগে। এখানে একটি কথা না বললেই নয়; তা হলো স্বাদু বা মিষ্টি পানির কাঁকড়া জীব বৈচিত্রের দিক দিয়ে প্লাস পয়েন্টে থাকলেও বাণিজ্যিক দিক দিয়ে অতটা গ্রহণযোগ্যতা তথা জায়গা দখল করতে পারেনি বিধায় আলোচনার ক্ষেত্রে কেবল লোনা পানির কাঁকড়ার উপর গুরুত্ব দিচ্ছি। যাহোক, কাঁকড়ার দেহ একাধিক খন্ডে বিভক্ত এবং এর শিরোবক্ষ বেশ বিকশিত এবং উদরদেশ খুবই খাটো। এদিকে এর মস্তকভাগ ছয়টি, বক্ষ আটটি ও উদর ছয়টি খন্ড দ্বারা সংগঠিত। একই সাথে এর প্রথম দেহখন্ড ব্যতীত প্রতি দেহ খন্ডে এক জোড়া এক শাক বা দ্বিশাক উপাঙ্গ থাকে। আর এর পাঁচ জোড়া পা, যা দিয়ে গত খোঁড়া, সাঁতার কাটা, দৌড়ানো, বেয়ে ওঠা, ইত্যাদি কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। মূলত কাঁকড়া নিজেদের লুকিয়ে রাখার জন্য গর্ত করে। তবে গর্তের আকার নানা ধরনের, যা নির্ভর করে এদের প্রকৃতি ও আকৃতির উপর। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, লোনা পানির কাঁকড়া ত্বক নির্মোচন এবং প্রজননকালে এ সব গর্ত ব্যবহার করে। সত্যি কথা বলতে কি, মানুষের মতো কাঁকড়া প্রায় সারা বছর ধরে প্রজনন করলেও প্রধানত মে থেকে আগস্ট এবং একই সাথে ডিসেম্বর হতে ফেব্রæয়ারী পর্যন্ত এই কয় মাস অধিক প্রজনন করে থাকে। তাই এই সময়কাল প্রজনন মৌসুম বলে অভিহিত করলে বেশী বলা হবে না। সাধারণত লোনা পানির কাঁকড়া সমুদ্রের পানিতে ডিম ছাড়ে এবং জোয়ারে সেগুলির লার্ভা সমুদ্রকূলে চলে আসে। লার্ভা ডিম থেকে বের হওয়ার ছয় মাসের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক হয় এবং এদের শরীর-নিঃসৃত হরমোন জননগ্রন্থির পরিপক্কতা ও প্রজনন প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। প্রাপ্তবয়স্ক একটি কাঁকড়ার ওজন ৩০০ থেকে ৬০০ গ্রাম এবং বড় জাতেরগুলি এক কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। আশ্চর্যের বিষয় হলো যে, শত্রু থেকে মুক্ত রাখতে স্ত্রী কাঁকড়া নিষিক্ত ডিমগুলিকে চওড়া উদরে ধারণ করে বয়ে বেড়ায়। এদিকে সদ্যজাত লার্ভা (তড়বধ-১) প্রথমে ভাসমান জীবন কাটায় এবং কয়েকবার ত্বক নির্মোচনের পর এবং একক মেগালোপা পর্যায়ে পরিবর্তিত হয়ে অপ্রাপ্তবয়স্ক তলজীবী কাঁকড়ায় রূপান্তরিত হয় এবং তৎপর উপকূলে এসে নদীর মোহনা, নদী, কর্দমযুক্ত ও লোনা পানি বিধৌত ম্যানগ্রোভ বনে প্রাপ্তবয়স্ক কাঁকড়ায় পরিণত হয়ে থাকে। সাধারণত এরা নিজে শিকার করে কাকর-বালিভুক পলিকেট সহ অন্যান্য প্রজাতির কাঁকড়া, শামুক জাতীয় প্রাণী ও মরা মাছ খেয়ে থাকে। তাছাড়া কাঁকড়া বর্জ্যভুক তথা সর্বভুক। এরা একই সঙ্গে তৃণভোজী এবং মাংসাশীও হয়ে থাকে। তবে ভারুনা লিটারাটা জাতীয় কাকড়া মূলত তৃণভোজী।
ই) বাংলাদেশে কাঁকড়া চাষ এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী কর্মকান্ড। রপ্তানিযােগ্য এই পণ্যের মধ্যে বলতে গেলে মূলত কর্দম কাঁকড়ার কথা উঠে আসে। আর এর উৎস হলো অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত সুন্দরবন ও সুন্দরবনের চারপাশের অঞ্চল এবং মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত উপকূলীয় চিংড়ি চাষ অঞ্চলসহ সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, পাইকগাছা, বাগেরহাট এবং মংলা অঞ্চলে নির্মিত অস্থায়ী জলাধারসমূহ। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদাবৃদ্ধি ও প্রকৃতিজাত কাঁকড়ার সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণে এই ম্যানগ্রোভ এলাকায় কাঁকড়ার চাষ অধিকতর গুরুত্ব পেয়েছে। আর বাংলাদেশসহ এশিয়ার দেশগুলিতে বাণিজ্যিক কাঁকড়া হিসেবে প্রধানত এই স্কিলা সিরাটা কাঁকড়ার এর মধ্যে সীমাবদ্ধ। যদিও জাপান উন্মুক্ত জলাশয়ের হ্যাচারিতে নীল কাকড়ার চাষ করে আসছে। কেননা বড় পুকুরে কাঁকড়ার স্বজাতিভক্ষণ একটি বড় সমস্যা। এর মধ্যে রাজ কাঁকড়ার লার্ভা পালন এবং পোনা উৎপাদনেও সাফল্য অর্জিত হয়েছে। কাঁকড়া চাষে বীজ উৎপাদন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর কাঁকড়ার বীজের উৎসগুলি হলো দুটি; যেমন-পোনা উৎপাদন কেন্দ্র এবং প্রাকৃতিক জলাশয়। তাইওয়ান, চীন, মালয়েশিয়া, জাপান, ভারত, ইত্যাদি দেশের হ্যাচারিতে বীজ উৎপাদনের কথা শোনা গেলেও অধিকাংশ কর্মকান্ডই আসলে পরীক্ষামূলক। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশে প্রাকৃতিক আবাসস্থল থেকেই কাঁকড়ার সব বীজ সংগৃহীত হয়ে থাকে। কাঁকড়া সচরাচর ৬ মাসে প্রাপ্তবয়স্ক হয় এবং চোখের বৃন্ত অপসারণের ১০ দিনের মাথায় ডিম ছাড়ে। আর ২৩০-২৫০ সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ১৭ দিন পর পোনা বের হয়। উল্লেখ্য যে, একটি ২৫০ গ্রাম ওজনের স্ত্রী কাকড়া ১৫ লক্ষ (প্রথম পর্যায়) লার্ভা উৎপাদন করে। আর এদের মেগালোপা স্তরে পরিণত হওয়ার জন্য প্রতিবার আন্তঃত্বক নির্মোচনে ২-৩ দিন সময় লাগে। তৎপর মেগালোপা ৭-৮ দিনের মধ্যে রূপান্তরিত হয়ে অপ্রাপ্তবয়স্ক কাঁকড়ায় পরিণত হয়। প্রথম পর্যায় থেকে মেগালোপা ও অপ্রাপ্তবয়স্ক পর্যন্ত পৌছতে প্রচুর পোনা মারা পড়ে। যদিও ডিম থেকে পোনা বের হওয়ার হার প্রায় শত ভাগ। যাহোক, লার্ভার আহার হিসেবে রোটিফার ব্রাইন শ্রিস্মস, কোপিপোড, ইত্যাদি সরবরাহ করা হয়। লার্ভা পালনের জন্য অধিক লবণযুক্ত সামুদ্রিক পানিই উত্তম। যদিও খামার মালিকরা এখনও প্রাকৃতিক উন্মুক্ত জলাশয়েরর কাঁকড়া বীজের উপর নির্ভরশীল। সেহেতু বাংলাদেশে কাঁকড়া চাষ প্রসারে সীমাবদ্ধতার ক্ষেত্রে বীজ সংগ্রহ একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অধিকাংশ খামার মালিক বিভিন্ন ধরনের জালের মাধ্যমে জোয়ারভাটা সম্বলিত নদী ও সমুদ্রের উপকূল থেকে কাঁকড়া বীজ সংগ্রহ করে থাকে। আর সারাবছর এই বীজ তথা রেণু পাওয়া গেলেও গ্রীষ্মকালে (মে-আগস্ট) ও শীতকালে (ডিসেম্বর- ফেব্রুয়ারি) অধিক পাওয়া যায়। উল্লেখ্য যে, বঙ্গোপসাগরসহ ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় এই কাঁকড়া ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে রয়েছে। চাষপদ্ধতির আওতায় বড় খামারে কচি কাঁকড়া বড় করা এবং ত্বক নির্মোচনের পর পরিচর্যার মাধ্যমে মোটাতাজাকরণপূর্বক বিক্রয়যোগ্যকরণ হলো উল্লেখযোগ্য বিষয়। এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য যে, কাঁকড়া বড় করার ক্ষেত্রে সাধারণত বড় পুকুরে বীজ মজুদ করা হয় এবং বিক্রয়যোগ্য আকারে না হওয়া পর্যন্ত এদেরকে খাদ্য সরবরাহ সহ জলাধারের পানি বদলানো হয়ে থাকে। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ সহ প্রায় এশীয় দেশীগুলিতে সনাতনী চিংড়ির ঘেরে কাঁকড়ার চাষ করা হয়ে থাকে। আর ছোট কাঁকড়া বিক্রয়যোগ্য আকারের (৩০০-৫০০ গ্রাম) না হওয়া পর্যন্ত প্রায় ৬ থেকে ৮ মাস এসব ঘেরে প্রতিপালিত হয়ে থাকে। এদিকে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো কাঁকড়ার সংগ্রহের ব্যাপারে বেশ লোক নিয়োজিত। এই সংগ্রাহকরা সাধারণত ছোট নৌকা ও বরশি ব্যবহার করে থাকে। তাছাড়া এগুলো ধরার জন্যে নানা ধরনের জাল ও ফাঁদ পেতে থাকে। ধরার পর ভিজা চটের থলে ও বাঁশের ঝুড়িতে তাজা কাঁকড়া আরতে পাঠানো হয়; সেখানে গ্রেডিংয়ের আওতায় বিভিন্ন ধরনের কাঁকড়া বাছাই করে চুড়ান্ত প্যাকিংয়ের জন্যে ঢাকার প্রেরণ করা হয়। আর সেখান থেকে সরাসরি রপ্তানি করা হয়ে থাকে। এদিকে প্রতিপালিত তথা চাষকৃত কাঁকড়া একই পদ্ধতিতে প্যার্কিংপূর্বক বিদেশে পাঠানো হয়ে থাকে।
ঈ) ডিমওয়ালা কাঁকড়া (পরিপক্ক ডিম্বাশয়সহ স্ত্রী কাঁকড়া) এবং শক্ত খোলসের মাংসল কাঁকড়া (পুরুষ কাঁকড়া) উৎপাদনের জন্য পুকুরে এককভাবে চাষ করা হয়। এশিয়ার বাজারে ডিমওয়ালা স্ত্রী কাঁকড়া সবচেয়ে মূল্যবান এবং প্রতি কিলোগ্রাম প্রায় ১৪ মার্কিন ডলারে বিক্রি হয়। কাঁকড়া মোটাতাজা এবং বড় করার জন্য এদের শামুক, বর্জ্য, মাছ ও অন্যান্য বিশেষ খাদ্য দেওয়া হয়। মার্টির পুকুরেই প্রধানত এদের চাষ করা হয় এবং পালানো বন্ধের জন্য তাতে বাঁশ ও নাইলন জালের ঘের করে দেওয়া হয়। এদের মোটাতাজাকরণ চক্র সংক্ষিপ্ত (সাধারণত ১ থেকে ২ মাস) এক্ষেত্রে পানির প্রতি বর্গমিটারে ৩টি কাঁকড়া রাখা হয়। প্রতিদিন এদের দেহের ওজনের প্রায় ৫% খাবার খাওয়াতে হয়। এদিকে ছোট ঘেরা জায়গায় বা খাঁচায় মোটাতাজাকরণের ব্যবস্থাও চালু আছে বাংলাদেশের বৃহত্তর খুলনার পাইকগাছা, মংলা, সাতক্ষীরা, কালীগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জে। এক্ষেত্রে ছোট পুকুরে (৬০-৬০০ বর্গমিটার আকৃতির), চাষ করা হয়। আর এখানে পানির মান বজায় রাখার জন্য পানি পরিবর্তন, পরিষ্কার করা ও চুন মিশানো ইত্যাদি সুবিধা রয়েছে। তাছাড়া উপযোগী তাপমাত্রা ও লবণাক্ততা যথাক্রমে ১০০-২৫০ সেঃ এবং ১৫-৩০পিপিটি বজায় রাখা হয়। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, উপক‚লীয় পরিবেশের নিরিখে উত্তম ব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়ের জন্য ঐতিহ্যগতভাবে এশিয়ায় মাড ক্র্যাব চাষ একটি ক্ষুদ্রায়তন কর্মোদ্যোগ। এক্ষেত্রে আমাদের দেশে ‘সাদা-দাগ’ ভাইরাস রোগের কারণে পরিত্যক্ত চিংড়ি ঘের বা পুকুরই প্রধানত কাঁকড়া মোটাকরণের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলাদেশে কাঁকড়া চাষের প্রধান বাধা বীজ সংকট, যা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। এদিকে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া জুড়ে প্রকৃতিজাত কাঁকড়া কমে যাওয়ার কারণ হলো অধিক আহরণ; প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ আবাসস্থল ধ্বংস, উপক‚লীয় পরিবেশের অবনতি, ইত্যাদি। যদিও বর্তমানে হ্যাচারি ও নার্সারিগুলোতে বাণিজ্যিকভাবে কাঁকড়ার বীজ উৎপাদনের দিকে নজর সহ গবেষণা চলছে। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য যে, লাগসই চাষ প্রযুক্তি উন্নয়ন ও প্রয়োজনীয় অর্থ বিনিয়োগ দ্বারা আগামীতে বাংলাদেশে মাড ক্র্যাব চাষের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে উঠার বিষয়টি খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য যে, সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ, দেবহাটা, শ্যামনগর, ও আশাশুনি উপজেলায় গত অর্থবছরে ৩০৭ হেক্টর জমিতে ৩ হাজার ২০০ মেট্রিকটন কাঁকড়া উৎপাদিত হয়। আর চিংড়ির চেয়ে কাঁকড়া চাষ লাভজনক হওয়ায় এখানকার চাষিরা কাঁকড়াতে বেশি অর্থ বিনোয়োগ করছে। স্থানীয় কাকশিয়ালী, কালিঞ্চি, খোলপেটুয়া ও কপোতাক্ষ নদ থেকে চাষিরা কাঁকড়ার পোনা সংগ্রহ করে থাকে। প্রাসঙ্গিক না হলেও একটি কথা উল্লেখ না করা হলে কমতি থেকে যাবে। এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য যে, এই কাঁকড়া মনুষ্য জীবনের অনেক ক্ষেত্রে বেশ জায়গা জুড়ে আছে। আর এর অন্যতম প্রধান হলো জ্যোতিষ শাস্ত্রে এর প্রতিকৃতি বা প্রতিকীরূপ কর্কট রাশি বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে।

উ) কাঁকড়াকে আমরা অখাদ্য হিসেবে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখলেও এর যে যথেষ্ট মূল্যমান রয়েছে, তা হয়তো সম্মানিত পাঠকবর্গ ইতিমধ্যে অনুবাধন করতে পেরেছেন। এটি হারাম বা মাকরু যাই হোক না কেন, বাংলাদেশের জিডিপিতে বিশেষ ভূমিকা খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। কেননা বাংলাদেশ বছরে সিঙ্গাপুর, হংকং, চীন, তাইওয়ান, বেলজিয়াম, যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানী, জাপান, ইত্যাদি দেশে ১৫০০ মেট্রিক টন লোনাপানির কাঁকড়া রপ্তানি করে প্রায় ৬০ লক্ষ মার্কিন ডলারের সমপরিমান অর্থ আয় করে থাকে। আর দিন দিন এটা বেরে চলেছে। এদিকে কাঁকড়ার সংগ্রহ, অস্থায়ী জলাধারে কাঁকড়া চাষ এবং ব্যবসা তথা রপ্তানির কাজে প্রায় পাঁচ লক্ষ লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিয়োজিত। আর এতে প্রতীয়মান হয় যে, নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির পথ উম্মোচিত হয়েছে। তাছাড়া জীববৈচিত্র চক্রের আড়ালে জোয়ার ভাটার সন্ধিস্থলে বিশেষ করে সুন্দরবন ম্যানগ্রোভ এলাকার প্রাণী রয়েল বেঙ্গল টাইগার, বুনো শ্যূয়োর, শিয়াল, বানর, কুমির, পাখি, বড় মাছ, ইত্যাদির খাদ্য হিসেবে বিদ্যমান। এতদ্ব্যতীত গুণগত মান বিবেচনায় সুন্দরবনের কাঁকড়ার বিদেশে চাহিদা বেশী। আর চিংড়ির চেয়ে কাঁকড়া লাভজনক। কেননা প্রতি কেজি চিংড়ি যেখানে ৭০০-৮০০ টাকা; সেখানে কেজি প্রতি কাঁকড়া ১০০০ থেকে ১২০০ টাকায় বিক্রয় হয়। কাঁকড়ার রোগ বালাই তুলনামূলক কম বিধায় সুন্দরবন এলাকার ১৩টি উপ জেলায় কাঁকড়ার চাষ বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধু ব্যবসায়িক দিক দিয়ে নয়। পর্যটন শিল্পে তুলনামূলক কম হলেও কিছুটা ভূমিকা রয়েছে। কেননা সমুদ্রের উপকূল জুরে, বিশেষ করে পটুয়াখালী জেলার জাহাজমারা এলাকার লাল কাঁকড়া দৃষ্টিনন্দন বিধায় দর্শণার্থীর আগমনের পথ সুগম হয়েছে। বাংলাদেশে পাঁচ তারকা হোটেল সহ কতিপয় অন্য ধর্মালম্বীরা কাঁকড়া খেয়ে থাকে। অবশ্য এটি উল্লেখযোগ্য নয়। তাই অধিকাংশ কাঁকড়া বিদেশে রপ্তানি করা হয়ে থাকে। পরিশেষে এই মর্মে সরকার সহ প্রায় ১৮ কোটি লোকের কাছে সর্নিবন্ধ অনুরোধ যে কাঁকড়ার বিষয়টি তুচ্ছ জ্ঞান না করে এর উপর অধিক গুরুত্ব দিতে আমরা সবাই সচেষ্ট হই। কেননা কাঁকড়া চাষের ব্যাপারে বাংলাদেশ সম্ভাবনার দেশ। আর এই উপখাত থেকে আসতে পারে কোটি কোটি ডলার; যা এই ধান শালিকের দেশকে আরও উপরে উঠতে অন্যান্য প্যারামিটারের সম্পূরক নিয়ামক হিসেবে গঠনমূলক ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্বাস করি।

সহায়ক সূত্রাদি ঃ
১। বাংলা পিডিয়া।
২। দৈনিক ইত্তেফাক- ২৮/১১/২০১৯।
৩। দৈনিক স্বদেশ প্রতিদিন- ২৭/০১/২০২০।
৪। শামীম আহমেদ, শোলক, উজিরপুর, বরিশাল।
৫। লেখকের অভিজ্ঞতা।
৬। অন্যান্য সূত্রাদি।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ
এক ক্লিকে বিভাগের খবর