মিল্টন বিশ্বাস।।
‘মুজিববর্ষ’ উদযাপনের অন্যতম একটি বিষয় হলো বাংলাদেশের গৌরবময় ইতিহাসকে পুনরুদ্ধার করা এবং কৃতিসন্তানদের অবদানের যথাযোগ্য স্বীকৃতি প্রদানের ব্যবস্থা নেওয়া।এদিক থেকে জীবনবাজি রেখে যাঁরা দেশমাতৃকার মর্যাদা রক্ষার জন্য একাত্তরে লড়াই করেছেন তাঁদের ইতিবৃত্ত পাঠকের সামনে তুলে ধরা গুণী লেখকদের অন্যতম দায়িত্ব। লেখকের সেই দায়বদ্ধতার দৃষ্টান্ত হলো- ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ব্যারিকেডের পুরোধা আসাদুজ্জামান খান কামাল’ গ্রন্থটি।
সম্প্রতি প্রকাশিত স্বনামধন্য লেখক মো. আব্দুল বাকী চৌধুরী নবাবের লেখা আশি পৃষ্ঠায় মলাটবন্দি ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ব্যারিকেডের পুরোধা আসাদুজ্জামান খান কামাল’ শীর্ষক বইটি পড়লাম। বইটি প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগে বিভক্ত। প্রথমভাগে ৭টি প্রবন্ধ রয়েছে যা ইতিহাসের সত্যে জারিত হয়েছে।এর মধ্যে ছয়টি প্রবন্ধ আবার গল্পের মেজাজে রচিত। দ্বিতীয় অংশে চারটি কবিতা ও তিনটি ছড়া রয়েছে। প্রত্যেকটি লেখাই মুক্তিযোদ্ধা আসাদুজ্জামান খান কামালকে ঘিরে রচিত। অবশ্য এই বইটিতে একটি সম্পাদকীয় অংশ আছে। বইয়ের তের পৃষ্ঠায় এ ব্যাপারে যে কথাগুলো সম্পাদক বলেছেন, তার সাথে যেকোনো ব্যক্তি একমত পোষণ করবেন।অন্যদিকে সন্নিবেশকৃত প্রবন্ধভিত্তিক সত্য গল্পের ব্যাপারে বলতে গেলে একটি কথাই নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে, বইটিতে সত্যিই সুন্দর এবং অনুসরণীয় কিছু দিক-নির্দেশনা আছে যা যে কোনো পাঠককে আকর্ষণ করবে। আর এই বইয়ের লালবর্ণের কাভারের ক্ষেত্রে ধ্রুব এষ যে প্রচ্ছদ তৈরি করেছেন সে ব্যাপারে প্রশংসা পাওয়ার দাবিদার। এতদ্ব্যতীত প্রকাশনায় আছেন নবযুগ প্রকাশনী। এই প্রকাশনী এই বইয়ে তাদের আগের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। কেননা এর বাঁধাই, শিরোনাম বিন্যাস এবং আক্ষরিক এ্যানাটমিসহ সর্বক্ষেত্রে প্রকাশকের নিজস্বতার স্বাক্ষর রয়েছে।
বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ব্যারিকেডের পুরোধা আসাদুজ্জামান খান কামাল’ বইয়ের কেন্দ্রবিন্দু। লেখক মো. আব্দুল বাকী চৌধুরী নবাব নানাভাবে তাঁর সাহসী ও অসাধারণ কার্যক্রম ফুটিয়ে তুলতে সচেষ্ট হয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি তাঁর ক্ষুরধার লেখনিতে যে বিষয়টির উপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন, তা হলো আসাদুজ্জামান খান কামাল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের উত্তাললগ্নে ফার্মগেট ব্যারিকেডের ক্ষেত্রে নেপথ্যে থেকে সবকিছু পরিচালনা করেছেন এবং তিনিই এর পুরোধা হিসেবে সর্বসম্মতিক্রমে বিবেচিত। এ প্রেক্ষাপটে তিনি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান ‘স্বাধীনতা’ পদক পাওয়ার অধিকারী হলেও এতোদিন কেন দেয়া হয়নি, তা আমরা জানি না। তবে আমি মনে করি এক্ষেত্রে যথাযোগ্য সম্মাননায় তাঁকে স্বাধীনতা পদক দেয়ার ব্যাপারে সরকারকে লিখিতভাবে অবহিত করা যেতে পারে অথবা আমার এই সংক্ষিপ্ত গ্রন্থ-সমালোচনা সম্বলিত বিষয়াদিকে ভিত্তি করলে তাঁকে পদক দেয়ার ব্যাপারে আর কিছু আলোকপাত করার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না।
উপরন্তু এই চারণ কবি ও লেখক মো. আব্দুল বাকী চৌধুরী নবাবকে এই মর্মে ধন্যবাদ জানাচ্ছি যে, কালের পরিক্রমায় মুক্তিযুদ্ধের সত্য ঘটনাটির উপর যে কঠিন আস্তরণ পড়েছিল তা তিনি লেখার আলপনায় এঁকে জনসম্মুখে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। তবে কিছু কবিতায়, প্রবন্ধাংশে পুনরুক্তি পরিলক্ষিত হয়েছে। অবশ্য এর পেছনে কারণ হলো, গ্রন্থভুক্ত হওয়ার আগে এই প্রবন্ধগুলো পৃথক পৃথকভাবে জনপ্রিয় পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এজন্য এই পুনরুক্তি তেমন দোষের কিছু নয়। তাছাড়া ইতিহাসের কিছু প্রসঙ্গ আরও ব্যাখা দাবি করে, সেক্ষেত্রে বিস্তৃত বিবরণ প্রত্যাশিত ছিল। কারণ এতে সম্মানিত পাঠকদের কাছে আরও সম্যক ধারণা পাওয়ার পথ উন্মোচিত হতো।
তবে এই বইটি প্রণয়নের ক্ষেত্রে লেখক যে চাপা পড়া সত্য ঘটনা উদঘাটনে সচেষ্ট হয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, সেজন্য পাঠকবর্গের পক্ষ থেকে তাকে কায়মন বাক্যে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। পরিশেষে এই বলে সমাপ্তি টানছি, এই বইটি মুক্তিযুদ্ধের যে প্রতিপাদ্য ইস্যুকে ঘিরে রচিত হয়েছে, তা বাস্তবে ফলিত রূপ হিসেবে মহান মুক্তিযোদ্ধা আসাদুজ্জামান খান কামালকে স্বাধীনতা পদক দেয়া হলে তাঁকে যেমন মর্যাদা দেয়া হবে তেমনি দেশও কৃতিসন্তানের জন্য গৌরব বোধ করবে। অন্যদিকে লেখকের এত কষ্টসাধ্য লেখা নিষ্ফল হবে না।গ্রন্থটির বহুল প্রচার কাম্য। (মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ব্যারিকেডের পুরোধা আসাদুজ্জামান খান কামাল- মো. আব্দুল বাকী চৌধুরী নবাব, প্রচ্ছদ : ধ্রুব এষ, নবযুগ প্রকাশনী, ২০২০, মূল্য : ৩০০ টাকা)