সুইটি রাণী বণিক
আধুনিকতার প্রতিটি বিষয় তাঁর চরিত্রের ভেতরে গভীরভাবে বিরাজিত। তিনি মুক্তচিন্তার মানুষ; সংস্কৃতির বহুত্ববাদে বিশ্বাসী, অসাম্প্রদায়িক, নিজের ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, প্রগতিশীল চিন্তায় স্নাত। এমন আধুনিক চিন্তার মানুষ সমাজ-পরিমণ্ডলে খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। যে কেউ তাঁর কাছে আধুনিকতার পাঠ গ্রহণ করতে পারে। এর জন্য শ্রেণিকক্ষের দরকার হয় না। তাঁর লেখা, বলা এবং আচরণের দিকে চোখ খুলে রাখলেই শেখা হয়ে যায়। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ইতিহাসের মানুষ। একুশ ও একাত্তরের মতো জাতীয় ঘটনাকে তিনি নিজের কর্মে ও সৃজনে ধারণ করেছেন।
২.
১৯৫২ সালে সংঘটিত ভাষা আন্দোলনে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১৯৫৩ সালে ভাষা আন্দোলনের প্রথম সংকলন ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ প্রকাশে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন কবি হাসান হাফিজুর রহমানের সঙ্গে। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, “কিন্তু তার আগেই সেই অবিস্মরণীয় ঘটনা ঘটে গেছে—ভাষা আন্দোলন। পেনসিলে লেখা হয়ে গেছে ‘অমর একুশে’ কবিতা, ছাপাও হয়ে গেছে বোধ হয় ফজলুল হক হল বার্ষিকীতে। সেই থেকে মাথায় ঘুরছে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ সংকলনের পরিকল্পনা।
১৯৭১। বাঙালি জাতির জীবনে এক শ্রেষ্ঠ সময়। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান আগরতলা হয়ে কলকাতায় যান। তাঁর ছাত্র ড. মাহবুবুল হক লিখেছেন, ‘একাত্তরের জুন মাসের ৪-৫ তারিখের দিকে আমিও আগরতলায় পৌঁছাই।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশের সংবিধানের বাংলা ভাষ্য রচনার প্রধান দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সাবলীল ভাষায় রচিত সংবিধান সবার কাছে যে বোধগম্য হয়ে উঠেছিল, সে ভাষার উদাহরণ এমন—‘জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোনো আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসমঞ্জস হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে।’
মুক্তিযুদ্ধ, সংবিধান প্রসঙ্গ ধরেই আনা যায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা। দেশের সুশীল সমাজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ যুদ্ধাপরাধী হিসেবে গোলাম আযমের বিচারের জন্য গণ-আদালতের কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই আদালতে বিচার চলাকালে আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগনামা পাঠ করেছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। এই ভূমিকার কারণে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল। দেশদ্রোহের মামলা দায়ের হয়েছিল।
তাঁর পিএইচডি গবেষণার বিষয় ছিল ‘ইংরেজ আমলের বাংলা সাহিত্য বাঙালি মুসলমানের চিন্তাধারা (১৭৫৭-১৯১৮)’। এই গবেষণার জন্য তিনি ব্যয় করেছেন তিন বছর। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬০। ১৯৬৪ সালে গবেষণা গ্রন্থটি বই আকারে প্রকাশিত হয়। প্রকাশক লেখকসংঘ প্রকাশনী, ঢাকা। বইয়ের নাম দেন ‘মুসলিম মানস ও বাংলাসাহিত্য’।
মাত্র ২৫ বছর বয়সে তিনি পিএইচডি করেন ‘বাংলা সাহিত্য ও মুসলিম মানস’ শিরোনামে। অভিসন্দর্ভ তিনি উৎসর্গ করেছেন আরেক জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে। এটাই তাকে বাংলা গবেষণা সাহিত্যে স্থায়ী আসন দিয়েছিল। পরে ‘পুরনো বাংলা গদ্য’, ‘স্বরূপ সন্ধান’, ‘বিপুলা পৃথিবী’, ‘আমার একাত্তর’সহ বহু গ্রন্থ প্রণয়ন করেন।
৩.
পরিচিতি পান দেশের শীর্ষ গবেষক, চিন্তাবিদ ও সংস্কৃতিতাত্ত্বিক হিসেবে। বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকেই তার গবেষণা বাঙালি মুসলমানের মানসযাত্রা প্রসঙ্গ বাংলাদেশের সারস্বত সমাজ ও গবেষকদের মধ্যে চিন্তার বীজ বপন করেছিল। বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলন থেকে অদ্যাবধি সমাজজীবনের অসংগতি ও সংকটমোচনের জন্য বাঙালি যে সংগ্রাম করে চলছে, তাতে তিনি অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব দিয়েছেন। দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন সাজ্জাদ শরিফ। সেটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত তাঁর ‘আলাপে ঝালাতে’ বইটিতে। সেখান থেকে সাক্ষাত্কারের গুরুত্ব পূর্ণ বক্তব্য বিশ্লষণ করে দেশ কাল পাত্র তথা, সেই সময় থেকে এযাবৎ কাল তার সামাজিক, রাজনৈতিক সাহিত্য ধারার মুক্ত চিন্তার দার্শনিক বহিঃপ্রকাশ আমরা সার্বিক আলোচনা পাই। “
আনিসুজ্জামানের “রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক চিন্তা ভাবনায় বলেন , রবীন্দ্রনাথের প্রতি কৌতূহলটা নতুন করে জেগেছে ভাষা আন্দোলনের পর। এর আগে বেতারে রবীন্দ্রনাথের গান-নাটক হচ্ছে, কবিতা আবৃত্তি হচ্ছে, গল্প-উপন্যাসের নাট্যরূপ হচ্ছে। বাধা কিন্তু ছিল না। রবীন্দ্রনাথ আমাদের জাতিসত্তার সঙ্গে সহজেই জড়িয়ে ছিলেন। বাঙালি পরিচয়ের কথা যখনই ভাবা হলো, তখন স্বাভাবিকভাবেই রবীন্দ্রনাথ চলে এলেন। স্বাধীন মনের আত্মপ্রকাশ ও বঙ্কিমচন্দ্রকে অনুসরণ করে বলেন, আমি যে প্রথম দিকে বঙ্কিমচন্দ্রকে নিয়ে লিখেছি, সেটি অনেকটা অস্বাভাবিক। অত পেছনে কেন চলে গেলাম? আমি ভেবেছিলাম, বাংলা সাহিত্যের সবটুকু যদি আমার হয়, তাহলে বঙ্কিমচন্দ্র আমার নয় কেন? বঙ্কিমচন্দ্রের ব্যাপারে সমাজের বিদ্যমান যে-আপত্তি, সেটা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত, তা নিয়েও আমার প্রশ্ন ছিল। ‘বঙ্কিমচন্দ্র ও আনন্দমঠ’ নামে ১৯৫৩ সালে আমি প্রবন্ধ লিখি। আমাদের পাঠ্যবই সাহিত্য পরিচিতিতে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের অংশটি পরিবেশিত হয়েছিল কিন্তু অখণ্ডিতভাবে। আমার কাছে মনে হয়েছিল, বাংলা সাহিত্যে যা আছে, সবই আমার। বঙ্কিমচন্দ্র যদি সাম্প্রদায়িক হয়ে থাকেন, তাহলে এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজাও জরুরি, কেন তিনি সাম্প্রদায়িক হলেন? আবার বঙ্কিমচন্দ্রের প্রেরণায় যে এত মানুষ উপনিবেশ-বিরোধী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হলেন, সেটাও তো লিখতে হবে। এভাবে আমার মনটা অন্যরকমভাবে গড়ে উঠেছিল। বঙ্কিমচন্দ্রকে নিয়ে প্রবন্ধ লেখার পরই আমার মনে হলো, মুসলমানদের মধ্যে যারা স্বাতন্ত্র্যবাদী, তাঁদের চেতনার বিকাশের ধরন নিয়ে লিখতে হবে।
বঙ্কিমচন্দ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে-প্রকল্প গড়ে তুলেছিলেন, তার মধ্যে কি বাঙালি মুসলমানের প্রবেশাধিকার ছিল! বঙ্কিমচন্দ্রের সময়টাতে বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্তের বিকাশ হয়েছে। কাজেই তাঁদের মধ্যে যে-হিন্দু জাতীয়তাবাদ স্ফূরিত হলো, তার চেয়ে মুক্তদৃষ্টি অবলম্বন করার মতো বাস্তবতা সেখানে ছিল না। বঙ্কিমচন্দ্র একদিকে স্বাধীনতা চাইছেন, আবার ইংরেজ শাসনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছেন। ওই কৃতজ্ঞতাবোধও হিন্দু মধ্যবিত্তের বিকাশের আকাঙ্ক্ষা থেকে। তাঁর সাম্প্রদায়িক মনোভাবের পেছনেও সেই একই কারণ। কিন্তু তাঁকে যতটা সাম্প্রদায়িক বলা হয়, ততটা তিনি নন। কেননা তাঁর লেখায় অনেক উদার মুসলমান চরিত্রও আছে।
তিনি আরো উল্লেখ করেন, বাংলা সাহিত্যকে সম্পূর্ণভাবে পেতে গেলে তো রবীন্দ্রনাথকে ছাড়া হবে না। রবীন্দ্রনাথকে বুঝতে হবে দুভাবে। একটি নন্দনতাত্ত্বিক, অন্যটি সমাজবিষয়ক। তাঁর সমাজবিষয়ক লেখার মধ্যে ঢুকতে আমার দেরি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার আগে সেটা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু পরে সেগুলো পড়ে আমার মনে হয়েছে, রবীন্দ্রনাথ যে-বিষয়টাকে এভাবে দেখেছেন, আমরা তো তা সামনের দিকে নিয়ে যেতে পারি। রবীন্দ্রনাথ এভাবে নতুনরূপে আমাদের কাছে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠলেন। পশ্চিমবঙ্গের জন্য এটি জরুরি ছিল না। সামাজিক কোনো সংকট নিয়ে রবীন্দ্রনাথ কী বলছেন, সেই সমস্যার হেতু কী-এসব বিষয় থেকেই রবীন্দ্রনাথ আমাদের কাছে প্রাসঙ্গিক হয়ে গেলেন।
৪.
মুসলিম-মানস ও বাংলা সাহিত্য বইটির সর্বশেষ ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, আমরা যাকে ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন বলি, এর ইতিবাচক দিকগুলো আমাকে বেশি আকর্ষণ করেছে। ওয়াহাবি আন্দোলনের ইতিবাচক দিক হচ্ছে এর ইংরেজ-বিরোধী চেতনা। অন্যদিকে আবার এর সংকীর্ণতার দিকটিও উপেক্ষা করার মতো নয়। ফারায়েজি আন্দোলনের ইতিবাচক দিক হচ্ছে ইংরেজ-বিরোধী আন্দোলনে কৃষককে অন্তর্ভুক্ত করা। এর প্রভাবে আবার হিন্দু আর মুসলমানদের মধ্যে পার্থক্য খুব বেড়ে গেল। এমনকি এঁরা মুসলমান সমাজকেও বিভক্ত করে ফেললেন। এর চেয়ে বেশি কিছু আমি বলিনি। তবে বলা উচিত ছিল। বাঙালি মুসলমানদের বুঝতে হলে গবেষণাগ্রন্থটি এড়িয়ে যাওয়া কঠিন।
তিনি বলেন সমাজ থেকে যেমন কাজী আবদুল ওদুদ তাঁর বইয়ে ওয়াহাবি আন্দোলনের নেতিবাচক দিকটিও দেখিয়েছেন। আমি সেই দিকটি অগ্রাহ্য করেছি। আমি বেশি গুরুত্ব দিয়েছি ইতিবাচক দিকটির ওপর। যেমন পিরবাদের বিরোধিতা আমাকে আকৃষ্ট করেছে, কিন্তু এঁদের গোঁড়ামি যে বিরক্তিকর, সেদিকে গুরুত্ব দিইনি।
আনিসুজ্জামান স্যার উপলব্ধি করেন, তিনি শিকাগোতে আমার প্রবন্ধের আলোচনায় অধ্যাপক লয়েড রুডল্ফ্ কথাটা বলেছিলেন। আমি মন্তব্য করেছিলাম, রাধাকান্ত দেব রক্ষণশীল। তিনি বলেছিলেন, রাধাকান্ত দেবকে তুমি রক্ষণশীল লেবেল এঁটে দিচ্ছ কেন? মেয়েদের শিক্ষার জন্য তো তিনি বহু কিছু করতেন। তাঁর দুটো দিকই কি দেখা উচিত নয়? আমি সেটা স্বীকার করে নিয়েছিলাম। আমি লক্ষ করেছিলাম, প্রগতিশীল বা রক্ষণশীল—এর কোনো ভাগেই তাঁকে ফেলা যায় না। তাঁর মধ্যে দুটো দিকই আছে।
তিনি গবেষণায় মুসলিম বাঙালি সাহিত্যের মধ্যে সময়টা শেষ করেছেন ১৯১৮ সালে এসে। এই বিশেষ বছরটি বেছে নেওয়ার কারণ প্রথম মহাযুদ্ধের সমাপ্তি, বাঙালি মুসলমানের সাহিত্যের দিক থেকে বিশেষ করে,
সাহিত্যক্ষেত্রে নজরুল ইসলামের আবির্ভাব—দুটোই বুঝিয়েছেন। তিনি বলেন, ” ইচ্ছা ছিল ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত আসার। কিন্তু এমন একটি জায়গাও তো আমার চাই যেখানে সাহিত্য ও সমাজের ছেদ একসঙ্গে মিলবে। নজরুলের আবির্ভাব ১৯১৯ সালে। তাঁর আবির্ভাবে তো একটা বড় পরিবর্তন হয়ে গেল। সেখানে ছেদ টানাই আমার কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হলো।”
আনিসুজ্জামানের গবেষণার ক্ষেত্র বিচিত্র। আর তা শুধু সাহিত্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। তাঁর শৈশব চিন্তার বিকাশ থেকেসাহিত্য ভাবনার প্রকাশ অল্প বয়সে সিনেমা দেখে মনে হয়েছিল, আমি উকিল হব। পরে উকিল হওয়ার বাসনা হারিয়ে গেল। তখন থেকেই ভাবতাম, আমি সাহিত্য নিয়ে পড়ব, গবেষণা করব, সাহিত্যের শিক্ষক হব। সেভাবেই বাংলা সাহিত্য পড়া। বাংলা পড়তে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, সাহিত্যকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে পড়া যাবে না। এই পটভূমিতেই ইতিহাসের প্রতি আমার আগ্রহ তৈরি হয়েছে। পরবর্তীকালে আমার সম্পাদিত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের বিষয়ে অনেকে বলেন আমি নির্ধারিত ক্ষেত্রের বাইরে চলে গেছি। আমি তা মনে করি না। যে-সমাজ থেকে সাহিত্য তৈরি হচ্ছে, সেই একই সমাজে তো ধর্মান্দোলন হচ্ছে, অর্থনৈতিক জীবনও চালিত হচ্ছে। এগুলো অবিচ্ছেদ্যভাবে দেখার ঝোঁক আমার মধ্যে সবসময়ে কাজ করেছে।
আনিসুজ্জামান বাংলা সাহিত্যের পর্বভাগ প্রসঙ্গে বলেন,এ নিয়ে প্রশ্ন তোলার পেছনের উত্সটি হলো ১৯৭৩ সালে আমার প্যারিস ভ্রমণ। আমি গিয়েছিলাম কংগ্রেস অব ওরিয়েন্টালিস্টের দুশো বছর পূর্তি উপলক্ষে। যাঁরা আয়োজক ছিলেন, যে কারণেই হোক, তাঁরা আমাকে একটি অধিবেশনে সভাপতিত্ব করার দায়িত্ব দিলেন। ওখানে গিয়ে লক্ষ করলাম, তাঁরা আধুনিকতার সূচনা ধরছেন ষোড়শ শতক থেকে, আর আমরা ধরছি ঊনবিংশ শতক থেকে। পার্থক্য হচ্ছে সময়ের, কিন্তু পর্বের নামগুলো রয়ে যাচ্ছে একই রকম। আমার তখন মনে হলো, ওরা যে-পর্বগুলো করেছে, সেটা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় আমাদের এখানে সাহিত্য ইতিহাসের ভাগগুলো ঘটেছে।
তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন যে, উপনিবেশের বহু আগে থেকেই বাংলা গদ্য ছিল এবং ইতিহাসের ভেতর দিয়ে সেটি ক্রমশ নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তো বাংলা গদ্য ক্রমাগত বিকশিত হয়ে উঠছিল। নানা ক্ষেত্রে গদ্যের ব্যবহার বাড়ছিল। শুধু ব্যবহারিক ক্ষেত্রে নয়, ভাবের বাহন হিসেবেও। কাজেই এটি বিকাশ লাভ করতই। কিন্তু বাঙালির জীবনে পদ্যের অসাধারণ প্রভাব গদ্যকে আড়ষ্ট করে রেখেছিল। গদ্যে লেখা উচিত এমন বহু জিনিসও পদ্যেই লেখা হতো। গ্রিসে, ইতালিতে বা ইংল্যান্ডে আমরা দেখেছি, মধ্যযুগে তাদের কবিরা যেসব ধর্মগাথা রচনা করেছেন এবং যেগুলো যুগ যুগ ধরে তাদের মনকে প্রভাবিত করেছে—যেমন হোমার, ভার্জিল বা দান্তের মহাকাব্য—তারা সেগুলোকে উচ্চ সাহিত্যের মর্যাদা দিয়েছে। আমাদের প্রাচীন সাহিত্যেও কি এমন কিছু আছে যা হয়তো বৈষ্ণব জীবনী-সাহিত্য যে-গুরুত্ব পেতে পারত, আমরা তা দিইনি। তাছাড়া অন্য বিষয়ে আমরা কার্পণ্য করিনি। ইংরেজের সংস্পর্শে আসার আগে আমাদের সাহিত্যে অনুকরণ আর পুনরাবৃত্তিই ছিল প্রধান। তার মধ্যেও যে পালাবদল হয়নি, তা নয়। তবে তা হাতে গোনা। একেক শতাব্দীতে আমরা মাত্র একজন-দুজন করে বড় কবির নাম পাচ্ছি—চণ্ডীদাস, আলাওল, মুকুন্দরাম, ভারতচন্দ্র। এই বদল অবশ্যই বাঙালি সমাজের অন্তর্নিহিত প্রাণশক্তির পরিচয়। শক্ত একটি কাঠামো বজায় থাকছে যুগের পর যুগ। আবার সে কাঠামো ভেঙে হঠাত্ করে কেউ কেউ বেরিয়েও যাচ্ছেন। এটা অনিবার্যভাবে আমাদের সামনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। আবার এসব পরিবর্তনের মধ্যে কিছু কিছু বিষয় স্থিরও থেকে গেছে। যেমন নায়িকার কিন্তু ওই একই চেহারা। সব নায়িকার একই চোখ, একই নাক, একই ঠোঁট। এটা অবশ্য গ্রিক সাহিত্যেও আছে।
৫.
“আমার একাত্তর “গ্রন্থে – তিনি লিখেন,এবং কথোপকথন এ বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ কথাটি নিয়ে পরবর্তীকালে বহু কথা ও রাজনীতি হয়েছে। আবার ১৯৭২-এর সংবিধানে আমরা রাষ্ট্রের মূল স্তম্ভ হিসেবে চারটি ভাবাদর্শ পেয়েছিলাম।
আমাদের রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এগুলো ধীরে ধীরে বিকশিত হয়েছে। ১৯৪৮-৪৯ থেকে একেবারে ধাপে ধাপে জাতীয়তাবাদ, অসাম্প্রদায়িকতা, সমাজতন্ত্রের দিকে আমাদের ঝোঁক বেড়েছে। ১৯৫০ সালে ঢাকায় শাসনতান্ত্রিক সম্মেলনে বলা হয়, দেশের নাম হবে ইউনাইটেড স্টেটস অব পাকিস্তান। এটা ইসলামিক নয়, সেক্যুলার রাষ্ট্র হবে। এতে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন থাকবে, কেন্দ্রের হাতে থাকবে অল্প বিষয়। তাই বলা যায়, এই চার স্তম্ভের ধারণা কেবল একাত্তরে নয়, তার আগেই নানা রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে আস্তে আস্তে বিকশিত হয়েছে।
একাত্তর থেকে আমরা মূলনীতিগুলো তো অবশ্যই নেব। এগুলো ছেড়ে দেওয়া যাবে না। এর যেকোনো একটি বদলে গেলে বাংলাদেশেরও চেহারা বদলে যাবে। আমি চতুর্থ সংশোধনী মেনে নিতে পারি না, কারণ সেটি চার নীতির সঙ্গে যায় না। জিয়াউর রহমানের সংশোধন, এরশাদের সংশোধন—এগুলোর কোনোটাই মেনে নেওয়ার মতো নয়। বাংলাদেশ রাখতে হলে ওই চারটা স্তম্ভ আমাদের ধরে রাখতে হবে। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, গত ৪০ বছরে নানা ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে মনে হয় মানুষের মনোভাবের পরিবর্তন হয়েছে। ধর্ম নিয়ে যে-সম্প্রীতির বোধ আমাদের মধ্যে ১৯৭০-৭১ সালে ছিল, এখন সেটা অনেক ক্ষয় হয়ে গেছে। এখন আর কেউ দাঙ্গা হচ্ছে শুনে বাড়ি থেকে দৌড়ে আক্রান্তের পাশে ছুটে যায় না। অনেক আপত্তিকর ওয়াজ, নসিহত বা ফতোয়া মানুষ বিনা প্রতিবাদে মেনে নেয়। নেতাদের অনেকে বলেন, ধর্মের কথা না বললে সমর্থন চলে যাবে। ১৯৭০ সালে এটা মনে করার কোনো কারণ ছিল না। এমনকি ১৯৫০ সালেও না। ১৯৪৮-৪৯ সালে মওলানা ভাসানী অসাম্প্রদায়িক একটি দেশের কথা বলেছেন, সোহরাওয়ার্দী বলেছেন, ১৯৫৪-৫৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন। এঁরা পাকিস্তানের তুঙ্গ মুহূর্তে ধর্মনিরপেক্ষ সমাজকে দেখতে পেয়েছিলেন। ধর্ম এখন একটি দেখানোরও বিষয় হয়ে উঠেছে। আমরা সবাই এখন শুধু আলহাজ হয়েই তৃপ্ত নই। আমরা নিজের নামের পাশে আলহাজ লিখতে চাই। জানাতে চাই যে, আমি হজ করে এসেছি। আমরা বিসমিল্লাহ বলে বক্তৃতা শুরু করি। আগে সেটা কখনো ছিল না। মওলানা ভাসানী কখনো বিসমিল্লাহ বলে বক্তৃতা শুরু করেননি। নামাজ পড়ার সময় হলে নামাজ পড়েছেন। নিজেদের মুসলমান প্রমাণ করার কোনো চেষ্টা তখন ছিল না। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমরা যে-রাষ্ট্রীয় মূলনীতিগুলো পেয়েছিলাম, সেগুলোর পক্ষে নেতারা আমাদের টেনেছিলেন, এখন কেন আমাদের নেতারা জনগণকে তৈরি করছেন না? একাত্তরের পর গত চার দশকে তাহলে এ দেশে এমন কী ঘটল যে, আমাদের সমাজের বিশ্বাস ও মূল্যবোধ এভাবে ক্ষয়ে যাওয়ার তীব্র শঙ্কা দেখা দিল?
আনিসুজ্জামান এ প্রসঙ্গে বলেন, যে-পরাজিত শক্তি বলেছিল, বাংলাদেশ হলে ইসলাম থাকবে না; বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর তারা কিন্তু নিষ্ক্রিয় থাকেনি। তারা পাকিস্তানের আদর্শ প্রচার করে গেছে। তারা বোঝাতে চেয়েছে যে, মুসলমান স্বতন্ত্র, মুসলমানের পরিচয় আলাদা। এসব প্রচার অনেক কাজে দিয়েছে। আমাদের মায়েরা তো শাড়ি পরে নামাজ পড়ে মুসলমানের জীবন পার করে দিলেন। তারা বোঝাতে পেরেছে, শাড়ি পোশাক নয়। এ জন্য গ্রামের মা-বোনেরা তাদের চিরন্তন পোশাক শাড়ি ছেড়ে সালোয়ার-কামিজ পরতে শুরু করেছে। মাদ্রাসার সংখ্যা বেড়েছে। গ্রামে অনেকেই মাদ্রাসায় ছেলেমেয়ে পাঠাতে আগ্রহ বোধ করে, কারণ শিক্ষার পাশাপাশি সেখানে খাদ্য সরবরাহ করা হয়। আমি যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, সেখানকার কেন্দ্রীয় মসজিদের ইমাম সাহেব জামায়াত করতেন। মসজিদকে কেন্দ্র করে তিনি নানা রাজনৈতিক কাজ করতেন। পরে তাঁকে সরানো হয়। আমরা হয়তো দু-চারটা ঘটনা জানতে পারি। এ রকম অসংখ্য ঘটনা আছে।
৬.
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বুদ্ধিজীবীদের গণনিধনও স্বাধীনতার পরবর্তী পর্যায়ে বাংলাদেশের জন্য একটি ব্যাপক ক্ষতির কারণ হয়েছে? জাতির ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চার করা যদি বুদ্ধিজীবীদের অন্যতম দায়িত্ব হয়, তাঁদের অনুপস্থিতির কারণে আমরা একটি শূন্যতার মধ্যে পড়েছি। আমাদের প্রত্যক্ষ অস্থির রাজনীতি তো ছিলই। বাকশাল, বঙ্গবন্ধু-হত্যা, মুহুর্মুহু অভ্যুত্থান, দীর্ঘ সামরিক শাসন। কিন্তু ওই শূন্যতা পরবর্তীকালে জাতি হিসেবে তো আমাদের কোনো সামষ্টিক মূল্যবোধ বা ইতিহাসগত জমির ওপর দাঁড়ানোরও সুযোগ দেয়নি।
এ প্রসঙ্গে তার অভিমত, একাত্তরে আমরা যে বুদ্ধিজীবীদের হারিয়েছি, নিশ্চয় তাঁরা দেশের জন্য অনেক কিছু করতে পারতেন। আমরা তা থেকে বঞ্চিত হয়েছি। কাজেই বড় একটা ক্ষতি তো হয়েছেই। তবে সেটাও পূরণ হতে পারত। কিন্তু বঙ্গবন্ধু-হত্যার পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তিকে রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনলেন। এটা বড় একটা ক্ষতিকর পরিবর্তনের কারণ। একদিকে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধগুলো গৌণ হয়ে গেছে। অন্যদিকে নানারকম সুবিধাবাদের বিকাশ ঘটেছে। এই প্রক্রিয়া এরশাদ আমলেও চলল। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠতে পারল না। গড়ে উঠবে উঠবে করে আওয়ামী লীগ আমলেও তা গড়ে উঠল না। ফলে পুরোনো মূল্যবোধগুলো থাকল না, আবার নতুন কোনো মূল্যবোধও প্রতিষ্ঠিত হলো না। সার্বিকভাবে একধরনের সুবিধাবাদ জায়গা করে নিল। শহীদ বুদ্ধিজীবীরা চিরন্তন মূল্যবোধের কথা বলেছেন, শুভ-অশুভর কথা বলেছেন। কিন্তু আমরা তাকে আপেক্ষিক বলে, চরম সত্য নয় বলে সরিয়ে দিচ্ছি। আজকের যে সামাজিক অবক্ষয়, তার পেছনে এই কারণগুলো কাজ করেছে। এখনকার বুদ্ধিজীবীরা মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছেন বলে অনেক ক্ষতি হয়েছে।
৭.
কাল নিরবধি, আমার একাত্তর ও বিপুলা পৃথিবীপরপর এই তিনটি ধারাবাহিক আত্মস্মৃতি। নিছক আত্মস্মৃতি নয়, অনেকের সঙ্গে জড়িয়ে চলা একটা সময়ের আখ্যান। বাঙালি জাতির হয়ে ওঠার একটা সামাজিক রেখাচিত্র বইটিতে পাওয়া যায়। বাঙালির এই দীর্ঘ যাত্রাপথকে তিনি উত্থান-পতন হিসেবেই দেখিয়েছেন ।তিনি বলেন, আমরা যদি ১৯৭১ সালকে একটি বিশেষ সময় বলে ধরি-যখন মুক্তিযুদ্ধ হলো, বাংলাদেশ স্বাধীন হলো-তখন আমরা যে আদর্শ নিয়ে দেশ প্রতিষ্ঠা করলাম, সেটি উত্থানেরই ব্যাপার। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর যা হলো, সেটি পতন। কেননা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা যে জায়গাটিতে পৌঁছাতে চেয়েছিলাম, সেখানে আর পৌঁছাতে পারলাম না। আজও পারিনি। মৌলিক পরিবতর্নগুলো পঁচাত্তরের পরেই হলো-সংবিধানে হলো, রাষ্ট্রীয় জীবনে হলো। আজ আমরা যে সামপ্রদায়িকতা দেখছি, ধর্মনিরপেক্ষতার পাশাপাশি যে এখনো রাষ্ট্রধর্ম রয়ে গেছে-এগুলো তো সেই পতনেরই চিহ্ন। একটা প্রশ্ন স্বভাবতই জাগে যে এত কিছুর পর আমরা কি সামনের দিকে এগোচ্ছি, নাকি পিছিয়ে যাচ্ছি? যেমন ধরো, মুক্তিযুদ্ধের পর আমরা যুদ্ধাপরাধীদের যে বিচার চেয়েছিলাম, এত দিন পর সেটি পেয়েছি। এটা একটা ইতিবাচক দিক। তেমনি আবার রাষ্ট্র যে অনেক বিষয়ে ধর্মীয় মৌলবাদীদের কাছে আত্মসমর্পণ করছে বা তাদের সঙ্গে একধরনের আপস করছে-এটা একটা দুঃখজনক দিক। ধর্মের নাম করে একদিকে বাঙালি সংস্কৃতির বিরোধিতার চর্চা চলছে, অন্যদিকে গণজাগরণ মঞ্চের ঘটনা আমাদের দেখিয়েছে যে এ প্রজন্মের তরুণদের আমরা মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে যেমনটা উদাসীন ভেবেছিলাম, আসলে তারা তা নয়। তাদের মধ্যে সেই মূল্যবোধ আছে। পরস্পরবিরোধী কিছু লক্ষণ আমাদের মধ্যে আছে। এই ভাঙাগড়া আর উত্থান-পতনের মধ্য দিয়েই আমরা যাচ্ছি। এসব মেনে নিয়েই আমরা কীভাবে সামনে এগোতে পারব, সেটা নিয়ে ভাবতে হবে। নতুন প্রজন্মের কাছে আমরা ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে কীভাবে তুলে ধরছি, সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ধর্মকে যারা রাজনীতির হাতিয়ার করেছে, তারা যেভাবে মানুষের কাছে যাচ্ছে, আমরা সেভাবে পারছি না। এই যে আহমদিয়াদের ওপর আক্রমণ হলো, বাংলাদেশে এটা হবে, তা আমরা কখনো কল্পনা করিনি। বাংলাদেশে যে ধর্মীয় জঙ্গিবাদের উত্থান হবে, তা-ই বা কে ভেবেছিল! সহজ বুদ্ধিতে অনেকে বুঝতে পারছেন, এগুলো থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। ১৯৫০ বা ১৯৬০-এর দশকের সংস্কৃতির চর্চা ও আন্দোলনের সুফল রাজনীতির মধ্যে পাওয়া গেল। একদিক থেকে দেখলে তো সাংস্কৃতিক চর্চার ধারা এখন আরও ব্যাপক হয়েছে, ছড়িয়ে পড়েছে।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর আমাদের নেতারা বললেন, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র চাই। পাকিস্তানি আদর্শ তখন আরও জোরালো ছিল। কিন্তু অবাক করা বিষয়, তা থেকে মানুষ সহজে বেরিয়ে এল। আমরা বাংলাদেশের আদর্শ নিয়ে অগ্রসর হলাম। কিন্তু ১৯৭৫ সালের পর আমাদের রাজনৈতিক নেতারা একটা ধর্মীয় চেহারা দেখাতে তত্পর হলেন। সাংস্কৃতিক মহল থেকেও আমরা একটু পিছু হটলাম। সেই সুযোগে ধর্মকে কেন্দ্র করে আদর্শটা মহিরুহের আকার ধারণ করল। ১৯৯০ সালে সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর আমরা আশা করেছিলাম, এমন পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব হবে, যা আমাদের ১৯৭২-৭৩ সালের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কিন্তু আমরা সেটা আজও পারিনি। দেখা গেছে, দেশকে যারা ধর্মীয় রাজনীতির মধ্যে জড়িয়ে ফেলতে চায়, তারা অনেক বেশি সক্রিয়। এই অবস্থা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। কোন লক্ষ্য সামনে রেখে বাংলাদেশ হয়েছিল, কীভাবে হয়েছিল-আমাদের নেতাদের তা সবাইকে মনে করিয়ে দিতে হবে। আমাদের সংস্কৃতিচর্চার আনুভূমিক বিস্তার ঘটলেও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে এর যোগসূত্র প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এমন সমালোচনা করা হলে সেটা অসংগত হবে না। আমাদের যে সংস্কৃতিচর্চা, সেটা মূলত নগর ও শিক্ষিত মধ্যবিত্তকেন্দ্রিক। বৃহত্তর সাধারণ মানুষের কাছে আমরা একে নিয়ে যেতে পারিনি। আমরা যে গান গাইছি, তার কথা বা আমরা যে নাটক করছি তার ব্যঞ্জনার মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানো মুশকিল। ধর্ম নিয়ে যারা রাজনীতি করে, তারা সেটা পেরেছে নানা রকম ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। সংস্কৃতির এই জনবিচ্ছিন্নতা কীভাবে দূর করা যাবে, সেটা বলা মুশকিল। সে অর্থে বলা যায়, লোকসংস্কৃতির সঙ্গে নগরসংস্কৃতির যে ব্যবধান, আমরা তার ফাঁদে পড়ে গেছি।
৮.
শিল্প, সাহিত্য বা সংস্কৃতির কাছেই তো এই যোগ আমরা প্রত্যাশা করি। আপনার কি মনে হয়, আমাদের সাহিত্য বা সংস্কৃতির পক্ষে এখনো সেই যোগসূত্র গড়ে তোলা সম্ভব নিশ্চয়ই। আমার তো মনে হয়, সেটা কিছুটা হচ্ছেও। আমি আবার সেই নাগরিক মধ্যবিত্তের কথা বলি। সাহিত্যের মধ্য দিয়ে তাদের কাছে যে বাণী পৌঁছাচ্ছে, সেটা মূলত প্রগতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষ ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন। কিন্তু পৌঁছানোর একটা সীমা রয়েছে। গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে সেটা পৌঁছাতে পারছে না। এই সাহিত্যের পক্ষে সেটা কঠিন। এটা এক জটিল সমস্যা। শুধু বাংলাদেশের আদর্শের ক্ষেত্রেই নয়, সাধারণভাবে বাঙালি সংস্কৃতির জন্যই এটা একটা বড় সমস্যা। তবে নগরের মানুষ এখন হয়তো আগের চেয়ে বেশি লোকসংগীত শুনছে, আবার টেলিভিশনের মাধ্যমে পল্লির মানুষও নাগরিক সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। এটা ব্যবধান মেটাতে একধরনের কাজ করছে। ইদানীং মাদ্রাসার ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমকক্ষ ডিগ্রি পেতে চাইছে। কারণ, তারা মনে করছে, যে ডিগ্রি তারা পাচ্ছে, সেটি দিয়ে বতর্মান দুনিয়ায় কিছু অজর্ন করা সহজ নয়। সুতরাং একটা সেতুবন্ধন তো হচ্ছে। সাহিত্য সেতু বন্ধন গরতে পরে! তার মতে, মানুষের মধ্যে যে ভয় ও সন্দেহ, তা অচেনা ও অজানাকে নিয়ে। সাহিত্যের মধ্য দিয়ে আমরা যখন সেই অজানা-অচেনাকে চিনতে পারি, তখন সন্দেহ ও ভয় অনেকটাই কেটে যায়। এ জন্য আমি মনে করি, ভারতের যে অংশে বাংলাভাষী মানুষ বাস করে, সেই অংশের মানুষের সঙ্গে ভুল-বোঝাবুঝি কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে দুই অঞ্চলের সাহিত্যই ভূমিকা রাখতে পারে। তা খানিকটা রাখছে বলেও আমি মনে করি।
স্বাধীন সার্বভৌম প্রতিঠার ফলে যে যে সুফল বাংলাদেশ রাষ্ট্র হওয়ার ফলেই কিন্তু বাংলাভাষী মানুষের পক্ষে সারা বিশ্বে দ্রুত ছড়িয়ে পড়া সম্ভব হয়েছে। আগে এটা ছিল না। এর একটা ভালো দিক আছে। অন্য দেশ সম্পর্কে আমরা জানছি। অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী যোগাযোগের ফলে আমাদের প্রগতির কিছু অন্তরায়ও দেখা দিয়েছে। যেমন মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের বড়সংখ্যক নাগরিক চাকরিবাকরি করছে। দেশে ফেরার সময় তারা ওই দেশের সংস্কৃতিটা সঙ্গে নিয়ে আসছে। বাংলাদেশে যে এখন হিজাব ছড়িয়ে পড়েছে, সেটা হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যপ্রবাসী বাঙালিদের মাধ্যমে। সৌদি আরবে বা মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে তারা ওখানকার সংস্কৃতিকে ইসলামি সংস্কৃতি বলে মনে করছে। তারপর দেশে ফিরে এসে ওই সংস্কৃতির চর্চা করছে। কিছুদিন আগে বাংলাদেশের তাঁতিরা বলেছেন, বাঙালি মেয়েরা শাড়ি কম পরছে। এটা যে ঘটছে, তার কারণ ওই যোগাযোগ। আবার দেশের মানুষ বিদেশমুখী হওয়ায় আমরা অনেক মেধা হারাচ্ছি। অনেক মেধাবী দেশের সঙ্গে সব চুকিয়ে দিয়ে বিদেশে গিয়ে বসবাস করছেন। এটা হয়তো তাঁরা বাধ্য হয়েই করছেন। আবার ওখানে যারা জন্মাচ্ছে, দেশের প্রতি তাদের পূর্বপুরুষের মতো টান না থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে এখন পর্যন্ত প্রবাসী বাঙালিরা দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে আমরা নানাভাবে তার প্রমাণ পাই।
সাহিত্যের ব্যাপারে বলতে হয়, বিষয়ের ক্ষেত্রে আমাদেও বৈচিত্র্য অনেক বেড়েছে। এখন আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী বাঙালির জীবনযাপন প্রণালি জানতে পারছি। সোভিয়েত ইউনিয়নে যাঁরা পড়তে গিয়েছিলেন, সাহিত্যে তাঁরা নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা লিখছেন। আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ বাড়ছে। এসব তো আগে ছিল না। এভাবে পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের লেনদেনের একটা প্রক্রিয়া চলছে। এটা ইতিবাচক।
৯.
বাঙালির ভালো-মন্দ মেশানো রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতির নানা উত্থান-পতন দীর্ঘ সময় ধরে দেখে, বাঙালির ভবিষ্যৎ প্রসঙ্গে আনিসুজ্জামান বলেছেন, আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বাঙালিত্বকে প্রতিষ্ঠা করা এবং বিশ শতকে যেসব উন্নয়ন ঘটেছে-এই শতক তো সবেমাত্র শুরু হলো-তার ফল সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া। এটা করা খুব সহজ নয়, কিন্তু এটা আমাদের করতে হবে। পশ্চাত্পদ যেসব ভাবনাচিন্তা সমাজে আছে, তার সঙ্গে আরও কিছুদিন আমাদের যুদ্ধ করতে হবে।
( লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, আইনজীবনী, এম এ বাংলা)