নিউইয়র্ক:
বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং পত্রপত্রিকায় ড. নূরুন নবী মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন-এর পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন বলে বিবৃতি দিয়েছেন। পদত্যাগ করা তাঁর অধিকার, কিন্তু এই বিবৃতিতে তিনি মুক্তধারা ফাউন্ডেশনকে নিয়ে এমন কিছু গুরুতর অভিযোগ এনেছেন যা সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, ভিত্তিহীন এবং মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের গত ৩৩ বছরের ঐতিহ্য এবং আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাঁর এই বিবৃতি পড়ে অনেকেই বিভ্রান্ত ও বিভাজিত হতে পারেন মনে করে মুক্তধারা ফাউন্ডেশন তাদের অবস্থান পরিষ্কার ভাবে তুলে ধরার প্রয়োজন বোধ করছে।
গত তেত্রিশ বছর ধরে বাঙালির হাজার বছরের গৌরবোজ্জ্বল সংস্কৃতি, বাংলা ভাষা এবং বাংলা সাহিত্যকে বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে যে সংগঠনটি সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে তার নাম মুক্তধারা ফাউন্ডেশন। শুধুমাত্র বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতিই নয় এই সংগঠনটি কাজ করে যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখতে—কাজ করে যাচ্ছে প্রবাসে বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের আত্মায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ছড়িয়ে দিতে।
প্রায় প্রতিটি বইমেলায় মুক্তধারা ফাউন্ডেশন সম্মাননা প্রদান করেছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের, আয়োজন করেছে বায়ান্ন ও একাত্তরের ওপর বিশেষ সেমিনার এবং চিত্র প্রদর্শনী। এই বইমেলাতেই শিশু-কিশোররা ছবি এঁকেছে মুক্তিযুদ্ধের, ছবি এঁকেছে বাংলাদেশের বিজয়ের, ছবি এঁকেছে বঙ্গবন্ধুর। মুক্তধারা ফাউন্ডেশন আয়োজিত শিশু-কিশোর মেলায় নতুন প্রজন্ম বানিয়েছে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য। প্রতি বছরের মতো এবছরের বইমেলায়ও থাকছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা। একটি পর্বে যোগ দিচ্ছেন ক্যাপ্টেন (অব.) সীতারা বেগম, বীরপ্রতীক। অতএব, এই সংগঠনকে ‘মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী’ তকমা দেওয়া মানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী চক্রকে শক্তিশালী করা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পরিচালিত একটি সংগঠনকে দুর্বল করতে পারলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী চক্রই লাভবান হবে।
ড. নূরুন নবী মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন ছিলেন, আহ্বায়ক ছিলেন তিনটি বইমেলার। কারণ, ড. নূরুন নবী একজন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বলেই মুক্তধারা ফাউন্ডেশন একজন মুক্তিযোদ্ধাকে পথচলার সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, তিনি তাঁর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেওয়া বিবৃতিতে এমন কিছু অভিযোগ এনেছেন যা সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং অনভিপ্রেত। তিনি মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের সিইও ও ইসি কমিটির সদস্যদের ‘একাত্তরের চেতনা বিরোধী’ বলে আখ্যা দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। অথচ বাস্তবতা হলো এই যে, মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের বর্তমান চেয়ারপারসন ডা. জিয়াউদ্দীন আহমেদসহ এই ফাউন্ডেশনের প্রায় অর্ধ ডজন কর্মীই মুক্তিযোদ্ধা অথবা মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান। ড. নূরুন নবীর এই মিথ্যা অভিযোগ এবং দূরভিসন্ধিমূলক বক্তব্যকে মুক্তধারা ফাউন্ডেশন নীতিগতভাবে তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছে।
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের ইসি কমিটির মেয়াদ শেষ হলে মুক্তিযোদ্ধা ডা. জিয়াউদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে নতুন ইসি কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু, ড. নূরুন নবী ২০২৫ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিতব্য ৩৪তম বইমেলা পর্যন্ত দায়িত্বে থাকার আগ্রহ প্রকাশ করলে মুক্তধারা ফাউন্ডেশন তাঁর প্রতি সম্মান দেখিয়ে এই প্রস্তাবে রাজি হয়, এবং ইসি কমিটির মেয়াদ ২০২৫ সালের মে মাস পর্যন্ত বর্ধিত করে। কারণ একই—ড. নূরুন নবী একজন মুক্তিযোদ্ধা। ২০২৪ সালের ছাত্র আন্দোলনে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ শাসিত সরকারের পতনের পর ড. নূরুন নবী দলটির পুনর্বাসন নিয়ে সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন। এটা তাঁর ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, মুক্তধারা ফাউন্ডেশন একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। একইসঙ্গে একটি অরাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃত্ব দেওয়া এবং একটি রাজনৈতিক দলের পুনর্বাসনে কাজ করতে গেলে যে ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ (স্বার্থের দ্বন্দ্ব) তৈরি হয় এখানেও তাই হয়েছে। এই ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি রাজনৈতিক দলের পুনর্বাসনে কাজ করাকে প্রাধান্য দেন এবং ২৬শে এপ্রিল থেকে মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের মেয়াদ বর্ধিত ইসি কমিটির চেয়ারপারসন-এর দায়িত্ব পালন করা থেকে বিরত থাকার কথা ব্যক্ত করেন। সেসময় আসন্ন বইমেলার আগেই পদত্যাগ করা অথবা মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের সরাসরি বিরোধিতা করার মতো কোনো মন্তব্য তিনি করেননি।
তিনি অন্যায় ভাবে মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের সিইও বিশ্বজিত সাহার প্রবাসে বাংলা বইমেলা শুরু করার মতো এক অসামান্য কৃতিত্ব, বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের সংস্কৃতি এবং ভাবমূর্তি তুলে ধরার জন্যে তাঁর আজীবনের অবদানকে অবমূল্যায়ন করেছেন। নিজ স্বার্থের প্রয়োজনে অথবা নিজের রাজনৈতিক লাভের জন্যে ৩৪ বছরের একটি ঐতিহ্যকে হেয় করে বিভাজন তৈরি করার অপচেষ্টা করেছেন। আমরা আশা করবো অচিরেই যেন তাঁর শুভবুদ্ধির উদয় হয়।
তাছাড়া কথাসাহিত্যিক সাদাত হোসাইনকে নিয়েও ড. নূরুন নবী অনেক মিথ্যা তথ্য ছড়িয়েছেন। উল্লেখ্য যে, সাদাত হোসাইন এবারের ৩৪তম নিউ ইয়র্ক আন্তর্জাতিক বাংলা বইমেলার আমন্ত্রিত অতিথি এবং তিনি বইমেলার উদ্বোধন করবেন। তিনি এই সময়ের একজন জনপ্রিয় লেখক এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তাঁর আদর্শ। কথাসাহিত্যিক সাদাত হোসাইন সম্পর্কে যাঁরা জানতে চান তাঁরা খুব সহজেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং অন্তর্জালে এই সত্যতা যাচাই করতে পারবেন।
গত তেত্রিশ বছর ধরে যাঁরা মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের পাশে ছিলেন, তাদেরকে মুক্তধারা ফাউন্ডেশন নিশ্চিত করতে চায় যে, ড. নূরুন নবীর সঙ্গে মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে তফাৎ শুধু এই যে তাঁরা রাজনৈতিক আদর্শে একে ব্যবহার করার বিরুদ্ধে। মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কেবল বাংলাদেশ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ব্যক্তিবর্গই ইসি কমিটির সদস্যপদ পেতে পারেন। গত তেত্রিশ বছরে বাংলাদেশ অনেক রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে, কিন্তু মুক্তধারা ফাউন্ডেশন কখনোই কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি সমর্থন প্রদর্শন করেনি, এবং এটি কখনোই কোনো রাজনৈতিক দলের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহৃত হবে না। মুক্তধারা ফাউন্ডেশন সবসময় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাবে।
এই বিবৃতি কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনকে উদ্দেশ্য করে নয়। এই বিবৃতি মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের সমস্ত শুভাকাঙ্ক্ষী ও শুভানুধ্যায়ী, যাঁরা গত তেত্রিশ বছর পথচলার সঙ্গী ছিলেন, তাঁদের জন্যে। এই বিবৃতির মাধ্যমে মুক্তধারা ফাউন্ডেশন তাঁদেরকে নিশ্চিত করতে চায় যে, মুক্তধারা ফাউন্ডেশন এখনো একই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে, যে লক্ষ্যে ১৯৯২ সালে প্রথম বইমেলা শুরু করেছিল। এবছর(২০২৫) ২৩শে মে শুরু হচ্ছে ৩৪তম বইমেলা।
মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে সবাইকে বইমেলায় আমন্ত্রণ।
…
মুক্তধারা ফাউন্ডেশন ইসি কমিটির পক্ষে,
রোকেয়া হায়দার, আহ্বায়ক, নিউ ইয়র্ক আন্তর্জাতিক বাংলা বইমেলা ২০২৫
ডা. জিয়াউদ্দীন আহমেদ, চেয়ারপারসন, মুক্তধারা ফাউন্ডেশন
বিশ্বজিত সাহা, সিইও, মুক্তধারা ফাউন্ডেশন